আইনের ‘ফাঁকফোকরে’ নিয়ন্ত্রণহীন তামাক
দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের সুনির্দিষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না তামাক। ফলে বিষাক্ত এ তামাকের ছোবলে মানুষের দেহে বাসা বাঁধছে ক্যান্সার, কার্ডিওভাস্কুলার, শ্বাসতন্ত্রের রোগসহ প্রাণনাশী নানা অসংক্রামক রোগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন থাকা সত্ত্বেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবহেলা এবং আইনের নানা ফাঁকফোকরে অধরা থেকে যাচ্ছে তামাক।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ১৩ দশমিক ৫ শতাংশই ছিল তামাক সেবনজনিত কারণ। যা সংখ্যায় প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার জন। এছাড়াও প্রায় ১৫ লাখ (১.৫ মিলিয়ন) প্রাপ্তবয়স্ক তামাক ব্যবহারের কারণে বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। এমনকি প্রায় ৬১ হাজার শিশুর অসুস্থতার কারণ ছিল তামাকের ব্যবহার।
বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। একটি সমীক্ষায় ঢাকার স্কুলগুলোর আশপাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে ৭ হাজার রাসায়নিক পদার্থ, যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান রাখার সুযোগ থাকায় পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।
‘নির্ধারিত স্থান’ বহাল রেখে অধুমপায়ীদের সুরক্ষা অসম্ভব
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ অনুযায়ী, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র ও থিয়েটার হলের ভেতরে, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ এক কক্ষবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশু পার্ক, খেলাধুলা ও অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত আচ্ছাদিত স্থান এবং এক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনসহ কিছু স্থান ব্যতীত বেশিরভাগ পাবলিক প্লেস ও একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদি) ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান' বা 'ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন' রাখার সুযোগ রয়েছে।
এরফলে অধুমপায়ীদের পাশাপাশি এসব স্থানে সেবা দিতে গিয়ে সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কাজেই বিদ্যমান আইনটি কোনোভাবেই পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৮ এর গাইডলাইন এবং অসংখ্য গবেষণা দ্বারাও এটা স্বীকৃত যে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশেপাশের স্থানসমূহ কখনই ধোঁয়ামুক্ত হয় না।
এই অবস্থায় তামাক নিয়ন্ত্রণে অধূমপায়ীদের রক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান' বা 'ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন' বিলুপ্ত করতে হবে। চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের হোটেল, পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং একাধিক কামরা বিশিষ্ট যান্ত্রিক পরিবহন ও সব অ-যান্ত্রিক গণপরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সব আচ্ছাদিত স্থানকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার ও নেপালের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য এখানে আরও সস্তা। খুচরা শলাকা ও খোলা তামাকপণ্য বিক্রয়ের ফলে এ সহজলভ্যতা ক্রমশ বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি
বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ হলেও বিক্রয়স্থলে পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি। আইনের এ সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো, যেখানে তরুণরাই মূল টার্গেট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ না হওয়ায় তামাক কোম্পানি তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে। এমনকি তামাকপণ্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট বা মোড়কের ডিজাইনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে তামাক কোম্পানিগুলো। এমনকি বিক্রয়কেন্দ্রে দৃশ্যমান স্থানে তামাকপণ্যের প্যাকেট সাজিয়ে রাখতে তারা বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে।
টোব্যাকো অ্যাটলাসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। একটি সমীক্ষায় ঢাকার স্কুলগুলোর আশপাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। ঢাকার ৭৬ শতাংশ পয়েন্ট অব সেল বা বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন হয়।
এ অবস্থায় দেশে বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন 'তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার' হিসেবে গণ্য করা হবে মর্মে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
খুচরা ও প্যাকেটবিহীন তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ জরুরি
বাংলাদেশে বেশিরভাগ ধূমপায়ী প্যাকেটের পরিবর্তে খুচরা শলাকা হিসেবে সিগারেট কিনে থাকে। খুচরা শলাকা বিক্রি তরুণ ও স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে ধূমপান সহজলভ্য করে তোলে। একারণে তাদের মধ্যে ধূমপান ছাড়ার চেষ্টা হ্রাস পায়। এদিকে, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য খোলা অবস্থায় বাজারজাতকরণের সুযোগ থাকলে এগুলোর উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং কর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। ফলে সহজলভ্যতা বৃদ্ধি পায় এবং স্বল্প আয়ের মানুষ ও নারীরা এসব পণ্য ব্যবহারে বেশি উৎসাহিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২১ সালের তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিয়ানমার ও নেপালের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। বিড়ি ও ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য এখানে আরও সস্তা। খুচরা শলাকা ও খোলা তামাকপণ্য বিক্রয়ের ফলে এ সহজলভ্যতা ক্রমশ বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। কাজেই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুচরা শলাকা ও খোলা তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করা অত্যন্ত জরুরি।
গবেষণায় দেখা গেছে, দৈনিক এক প্যাকেট সিগারেট ব্যবহারকারী একজন ধূমপায়ী সিগারেট কেনা ও ব্যবহার করার সময় দিনে কমপক্ষে ২০ বার, বছরে ৭ হাজার বার সিগারেটের প্যাকেটে ছাপানো ছবি দেখে থাকে। অথচ তামাকজাতপণ্য যখন খুচরা শলাকা বা খোলা হিসেবে বিক্রি হয় তখন স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা দেখা যায় না। ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্ক বার্তা তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না।
এই অবস্থায় বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ সংশোধন করে বিড়ি-সিগারেটের সিঙ্গেল স্টিক বা খুচরা শলাকা এবং প্যাকেট ব্যতীত বা খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য বিক্রয় নিষিদ্ধ করতে হবে।
তামাক পণ্যে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি জরুরি
বাংলাদেশে তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা চালু থাকলেও তামাকের ব্যবহার নিরুৎসাহিতকরণে তা যথেষ্ট কার্যকরী নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তামাকপণ্যের প্যাকেটে ৮৫ শতাংশ জায়গা জুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ করা হয়, নেপালে এটি ৯০ শতাংশ, অথচ বাংলাদেশে তা মাত্র ৫০ শতাংশ। তাছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার/আয়তন কেমন হবে এবং এর মধ্যে ন্যূনতম কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য/শলাকা থাকবে তা বর্তমান আইনে উল্লেখ নেই। অন্যদিকে আইনের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ওপরের ৫০ শতাংশ জায়গাজুড়ে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা মুদ্রণ বাধ্যতামূলক হলেও তা নিচের ৫০ শতাংশে মুদ্রণ করা হচ্ছে, যা অপেক্ষাকৃত কম কার্যকরী।
এ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করতে হবে এবং সবধরনের তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার আকার/আয়তন এবং এগুলোর মধ্যে ন্যূনতম কী পরিমাণ তামাকজাত দ্রব্য থাকবে তা নির্ধারণ করে দিতে হবে।
তামাক আইনে অপূর্ণতা রয়েছে : ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের আইন আছে, তবে আইনের অনেক ফাঁকফোকরও রয়েছে। একইসঙ্গে কিছু দুর্বলতাও রয়েছে। যার ফলে আইনটি তামাকের ব্যবহার কমাতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিশেষ করে পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনকে শতভাগ তামাকমুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ৭ ধারায় ‘ধূমপান এলাকা’ রাখার বিধান বাতিল করতে হবে।
তিনি বলেন, দোকানে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, সচিত্র সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি করা এবং বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করা জরুরি।
ড. আব্দুল হামিদ বলেন, তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বছরের মানুষের হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ হয়ে থাকে। আর তামাক পণ্যের ওপর আরোপিত ট্যাক্স পাই আমরা বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। সেখানে ক্ষতি হয় ৩০ হাজার কোটি টাকার অধিক। আমি যে পরিমাণ ট্যাক্স পাচ্ছি, তার চেয়েও যদি বেশি ক্ষতি হয়ে যায় ওই সব পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাবে, এর আসলে কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তিনি আরও বলেন, একটা পদ্ধতি সব সময় বলা হয়, সেটি হলো- সিগারেট, জর্দা, গুলসহ তামাকজাত সব দ্রব্যের ওপর ট্যাক্স বাড়িয়ে দেওয়া। এটি করা হলে অনেকাংশেই ধূমপান কমে আসবে বলে মনে করা হয়। তবে, যদি তামাক দ্রব্যের ওপর কর ৫০ শতাংশও বাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সরকারের রেভিনিউ বাড়বে, তবে তামাকের ব্যবহার কমবে কিনা সেটি দেখার বিষয় আছে। কারণ, যারা তামাক দ্রব্য ব্যবহার করে, তারা অনেকটাই অ্যাডিক্টেড কমিউনিটি (মাতাল প্রকৃতির জনগোষ্ঠী)। এটি কিন্তু স্বাভাবিক জনগোষ্ঠীর মত নয়।
ঢাবির এ অধ্যাপক বলেন, দ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে অ্যাডিক্টেড কমিউনিটির তামাক ব্যবহার হয়তো কিছুটা কমতে পারে, কিন্তু পুরোপুরি কমবে না। এক্ষেত্রে সে হয়তোবা ব্র্যান্ড চেঞ্জ করবে। বেশি দামি থেকে কম দামিতে আসবে। সব মিলিয়ে করারোপ করে দাম বাড়িয়ে যে খুব বেশি লাভ হবে, সেটি আমার বোধগম্য মনে হয় না। এক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাছে আরেকটি অস্ত্র আছে সেটি হলো উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। এখন যদি তামাক নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে সেটি বাস্তবায়ন করবে কে?
দাম বাড়িয়ে ‘সহজলভ্যতা’ কমাতে হবে: এবিএম জুবায়ের
দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমাদের দুটো পথ রয়েছে। একটি হলো অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ, আরেকটি নিয়মকানুনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ। অর্থনীতিক নিয়ন্ত্রণ বলতে আমরা বুঝি করারোপ করে, দাম বাড়িয়ে এটির সহজলভ্যতা কমিয়ে নিয়ে আসা। আর অন্যটি হলো, আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা। যেমন- পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করা, সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে অসুস্থতার যে ছবি আছে সেটির আয়তন বড় করে দেওয়া, শিশুদের কাছে বিক্রি বন্ধ করা, ভয়াবহ প্রভাবগুলো তুলে ধরার মাধ্যমে প্রচার-প্রচারণার ব্যবস্থা করা।
তিনি বলেন, তামাক পণ্যের দাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের দেশে অনেক কম। তাই আমরা চাচ্ছি তামাকজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে যেন এর ব্যবহার হ্রাস করা সম্ভব হয়। বিশেষ করে এটিকে তরুণ প্রজন্মের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে। তারা যেন তাদের পকেটের খরচ দিয়ে এটি আর কিনতে না পারে।
এবিএম জুবায়ের আরও বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে আমরা সম্প্রতি ৬টি সংশোধনীর কথা বলেছি। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেগুলোর খসড়া তৈরি করেছে। আমাদের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে কিছু ঘাটতি আছে, সেগুলোকে আমলে নিয়ে ৬টি সংশোধনীর প্রস্তাব আমরা করেছি। আমরা চাচ্ছি এই সংশোধনীগুলো যদি দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার প্রধানমন্ত্রীর যে ঘোষণা রয়েছে, সেটি বাস্তবায়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।
উৎপাদন বন্ধ নয়, হেভি করারোপ করতে হবে : ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক, ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাকের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া ও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন। ধাপে ধাপেই এটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। কারণ, সরকার এখান থেকে বড় রকমের একটি রাজস্ব পায়। বিকল্প কোনো রাজস্ব ব্যবস্থা না করে তো এটি বন্ধ করে দেওয়া কঠিন। অর্থনৈতিক চাকা বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাবনা আমরা সরকারকে যতই দেই, তারা সেটি শুনবে না।
তিনি বলেন, উন্নত বিশ্ব গুলোতে তামাক নিয়ন্ত্রণে করারোপের মাধ্যমে ভালো একটি ফলাফল পাওয়া গেছে। করারোপের মাধ্যমে তামাক পণ্যের দাম যতোই বাড়ানো যায়, ততই এর ব্যবহারকারী কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। যেমন- উঠতি বয়সের বাচ্চারা যেসব সিগারেট খায়, তারা ওই টাকা পায় কোথায় থেকে? তাদের টিফিনের যে টাকা দেওয়া হয়, সাধারণত সেই টাকা বাঁচিয়ে তারা তামাক গ্রহণ করে। এখন আমরা যদি তামাকের ওপর হেভি একটা কর আরোপ করি, তাহলে সিগারেট কেনার জন্য তার যে ক্ষমতা সেটি কমে যায়। তখন একটি বাচ্চার নতুন করে শুরু করার যেই আগ্রহ থাকে, সেটি কমে যাবে। এক মাসে এসে যদি আগে দশটা খেত, এখন সে পাঁচটা খাবে। দামটা যদি আরও বাড়ানো হয়, তাহলে আরও কমে যাবে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত এ প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করলে তামাকের ব্যবহার কমবে, সরকারের রেভিনিউ বাড়বে।
মহিউদ্দিন ফারুক বলেন, তামাক নিয়ে আমরা প্রায় ৩০টির মতো সংগঠন কাজ করছি। সরকারের পক্ষ থেকে তামাক নিয়ন্ত্রণে ৬৪টি জেলায় টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। সেখানে জেলা প্রশাসক থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের যারা আছে, তারাও সেখানে কাজ করবে। আর বাইরে থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের ১০ জন ব্যক্তি এ টাস্কফোর্সে রিসোর্স পার্সন হিসেবে কাজ করবে। এটি নিয়ে এ বছরই একটি ফরমেট করা হয়েছে। তাদের দায়িত্ব হলো জনসচেতনতা তৈরি করা।
এই ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগে কিছু কাজ তো করা হচ্ছে। কিন্তু আমার সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টির বিষয়টি হলো- তামাকজাত দ্রব্যের ওপর কর আরোপ করা বা কর আহরণ করার যেই ব্যাপারটি রয়েছে, সেটি যথাযথভাবে হচ্ছে না। তাছাড়াও বেশি কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এই কর ব্যবস্থাপনা একটু জটিল দেখেই ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতাটা বেশি দেখা যায়।
সচেতনতার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
সব বিশেষজ্ঞরাই একমত যে, শুধু দাম বাড়িয়ে বা আইন প্রয়োগ করেই তামাক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে সব স্থরে ব্যাপক সচেতনতার তাগিদ তাদের। এ বিষয়ে ড. আব্দুল হামিদ বলেন, আমরা যদি আমাদের বাচ্চাদের শেখাতে পারি তামাক গ্রহণের ফলে কী কী ধরনের সমস্যা দেখা দেয়, এর ভয়াবহতা কতটুকু। তা যদি আমরা শিক্ষা দিতে পারতাম, তাহলে হয়তো কিশোর বয়স থেকে অভ্যাসটা তাদের গড়ে উঠত না।
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, সাধারণত বাচ্চাদের যখন ১০ বছরের মতো বয়স হয়, যখন তারা পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে, তখন বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মিশে এই অভ্যাসটা গড়ে ওঠে। সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে যদি এই জায়গাগুলো ভেঙে দেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
এই বিষয়ে এবিএম জুবায়ের বলেন, যারা ইতোমধ্যেই তামাকে আসক্ত, তাদের কাছে দাম বৃদ্ধি হয়তো খুব বড় ধরনের বা বেশি কাজ করবে না। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন দামের কারণে এটিকে ধরতে না পারে। সেই জায়গায় এটিকে নিয়ে যাওয়া, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই কিন্তু এ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে সফলতা পেয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতায় কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, প্রতিটি তামাকজাত পণ্যে বীভৎস ছবি লাগিয়ে দিতে হবে। ট্রেনে, বাসে ও লঞ্চে তামাকের ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ১৮ বছরের নিচে কেউ সিগারেট কিনতে পারবে না -এমন একটি আইন রয়েছে, এটাকেও কঠোরভাবে প্রতিপালন করতে হবে। কেউ চাইলেই সিঙ্গেল স্টিক (শলাকা) কিনতে পারবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এটি নিষিদ্ধ নয়। আমরা চাই খুচরা শলাকা বিক্রি বন্ধ হোক। একটি সিগারেটের প্যাকেটের দাম যদি ৫০০ টাকা করে দেওয়া হয়, তাহলে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া একটি বাচ্চার পক্ষে এটি কেনা অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এ বিষয়গুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে ২০৪০ সালের মধ্যেই তামাকমুক্ত একটি জাতি গঠন করতে পারবো।
তামাকমুক্ত দেশ গড়তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করছে : মন্ত্রী
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সংগঠনের প্রস্তাবনাকে আমলে নেওয়া হয়েছে। তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়নে তামাক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ধাপে ধাপে কঠোরতা আরোপ করা হবে। ইতোপূর্বে তামাকপণ্যের প্যাকেটে ছবি ব্যবহার ছিল না, সেটি করা হয়েছে। এক সময় বিমানসহ বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে ধূমপানের সুযোগ ছিল। আইন করে সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বিদ্যমান আইনটি আরও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে আইনের সংশোধনী আনা হচ্ছে।
টিআই/এসএস/