বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সের ‘মনোপলি’, ঠকছেন হজযাত্রীরা!
করোনা মহামারির কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এবার বাংলাদেশিদের হজ করার অনুমতি দিয়েছে সৌদি আরব। এবার হজযাত্রীদের বিমানভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে জনপ্রতি এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। বরাবরের মতো হজযাত্রীদের বহন করবে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইন্স (সাউদিয়া)।
প্রতিবছর যাত্রীরা এ দুই এয়ারলাইন্সের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ভাড়া, যাচ্ছেতাই সেবা, শিডিউল বিপর্যয় ও অপেশাদার আচরণসহ নানা ভোগান্তির অভিযোগ করেন। এরপরও বার বার এয়ারলাইন্স দুটিকেই দেওয়া হচ্ছে হজযাত্রী পরিবহনের অনুমতি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বছরের পর বছর এ দুই এয়ারলাইন্সকে যাত্রী নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়ার কারণে তারা ‘মনোপলি’ মার্কেট তৈরি করে অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সরকারি-বেসরকারি তিন-চারটির বেশি এয়ারলাইন্স হজযাত্রী বহনের দায়িত্ব পায়।
সারা বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যে লোকসান করছে, তা হজ মৌসুমে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। সৌদি এয়ারলাইন্সও এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
তাদের ধারণা, সারা বছর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যে লোকসান করছে, তা হজ মৌসুমে পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের এ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। সৌদি এয়ারলাইন্সও এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সৌদি এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমানের বাইরে তৃতীয় কোনো এয়ারলাইন্সকে যদি হজ কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে তাদের একচেটিয়া ব্যবসা কমে আসবে। হজযাত্রীরাও কম খরচে এবং ভোগান্তি ছাড়া হজে যেতে পারবেন। ভালো সেবার একটা প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।
২০১১ সালের আগে হজযাত্রীদের পরিবহন করত যারা
এখন বিমান ও সাউদিয়া একচেটিয়া ব্যবসা করলেও ২০১১ সালের আগে এমনটি ছিল না। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব ছাড়াও ইয়েমেনের ইয়েমেনিয়া (ইয়েমেন এয়ারওয়েজ), কাতারের কাতার এয়ারওয়েজ, বাহরাইনের গালফ এয়ার, সৌদি আরবের ফ্লাই নাস, কুয়েতের কুয়েত এয়ারলাইন্স, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স (পিআইএ) বাংলাদেশের হজযাত্রী বহন করত।
তখন এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে কম ভাড়া নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো সুবিধা দিয়ে ইচ্ছেমতো এয়ারলাইন্সের টিকিট কেটে যাত্রীদের হজ প্যাকেজ অফার করত। তবে ২০১২ সালে হজের আগমুহূর্তে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেই চুক্তিতে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও সৌদি এয়ারলাইনস ছাড়া তৃতীয় কোনো এয়ারলাইন্স বাংলাদেশি হজযাত্রী বহন করতে পারবে না। এরপর থেকে এই দুই এয়ারলাইন্সের একচেটিয়া ব্যবসা শুরু হয়।
২০১৯ সালে সর্বশেষ হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এবার শুধুমাত্র জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এয়ারলাইন্সগুলোর ঢাকা থেকে জেদ্দা-মদিনা রুটে আসা-যাওয়ার ভাড়া ৭৫ থেকে ৭৭ হাজার টাকা।
২০১৯ সালে সর্বশেষ হজযাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। এবার শুধুমাত্র জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে এয়ারলাইন্সগুলোর ঢাকা থেকে জেদ্দা-মদিনা রুটে আসা-যাওয়ার ভাড়া ৭৫ থেকে ৭৭ হাজার টাকা।
ভারত-পাকিস্তানসহ প্রতিবেশী দেশগুলো কী করছে?
বাংলাদেশে দুই এয়ারলাইন্স একচেটিয়া ব্যবসা করলেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চিত্র এমন নয়। ভারতে প্রতিবছর সৌদি এয়ারলাইন্স ছাড়াও এয়ার ইন্ডিয়া, স্পাইস জেট, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস ও ইন্ডিগো এয়ার হজযাত্রী বহন করে। পাকিস্তানে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স, সৌদি এয়ারলাইন্স ও শাহীন এয়ারলাইন্স যাত্রী বহন করে। ইন্দোনেশিয়া থেকে লায়ন এয়ার, গারুদা ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি এয়ারলাইন্স যাত্রী বহন করে। (সেসব দেশের হজ ওয়েসবাইট থেকে পাওয়া তথ্য)
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সরকার ভাড়াও নির্ধারণ করে দেয় না। এয়ারলাইন্সগুলো ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করে। তাদের মধ্য থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্যাকেজটি বেছে নেয় ট্রাভেল এজেন্সিগুলো।
বিমান-সাউদিয়া আধিপত্যে বিরক্ত যাত্রী, হাব ও আটাব
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) জানায়, তাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো এয়ারলাইন্সকে অনুমতি দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে। তবে অজ্ঞাত কারণে বারবার বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সকেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। যাত্রীরা যেমন এ দুই এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে হেনস্তার শিকার হন, হাবের সদস্যরাও তেমনি হেনস্তার শিকার হন। যেহেতু বিকল্প নেই, তাই নানা অভিযোগ থাকলেও তাদের মাধ্যমেই হজযাত্রী পাঠাতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাবের কার্যনির্বাহী কমিটির একজন সদস্য বলেন, বিমানের অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা হজযাত্রীরা অনেক হেনস্তার শিকার হচ্ছি। যেমন কোনো যাত্রী যদি হজের টাকা জমা দেওয়ার পর মারা যান, সেই যাত্রীর টিকিটের নাম বদলে অন্য যাত্রী পাঠাতে তারা (বিমান ও সাউদিয়া) ৩০০ মার্কিন ডলার নেয়। কেউ যদি কাগজপত্র বা অন্য ত্রুটির কারণে ফ্লাইট পরিবর্তন করতে চায়, সেক্ষেত্রে দুই এয়ারলাইন্সই ৩০০-৫০০ ডলার ফি নেয়। তারা এসব ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না, বরং টাকা দিয়েও অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
হাবের সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাত্র দুটি এয়ারলাইন্সকে দায়িত্ব দিলে ভাড়া যেমন বেশি থাকে, তেমনি যাত্রীরা ভালো সেবা থেকে বঞ্চিত হন। এছাড়া এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের নাম পরিবর্তনসহ অন্যান্য পরিবর্তনে অতিরিক্ত ফি নেয়। এতে যাত্রীদের খরচ অনেক বেড়ে যায়। তাই আমরা দীর্ঘদিন ধরে অন্য কয়েকটি এয়ারলাইন্সকে অনুমতি দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছি। তবে এবারও তা করা হয়নি।
ভাড়া বেশি নেওয়ার পেছনে যে ঠুনকো যুক্তি
২৭ এপ্রিল বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী হজযাত্রীদের ভাড়ার পরিমাণ ঘোষণা দেন। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও এতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বড় সম্পৃক্ততা থাকে।
বেশি ভাড়া নির্ধারণের বিষয়ে জানতে চেষ্টা করেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামালের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে বিমানের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স হজের মৌসুমে যাত্রী পরিবহন করে নিয়ে গেলেও ফিরে আসে ফাঁকা। ফিরে আসার সময় যাত্রী না পাওয়ায় দ্বিগুণ ভাড়া ধরা হয়।
বিমানের ব্যাখ্যা মানতে নারাজ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা
বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান কাজী ওয়াহিদুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিমানের ফিরতি ফ্লাইট ফাঁকা বলে ভাড়া বেশি— এটি আসলে কোনো যুক্তি নয়। এতে বিমানের পরিকল্পনার অভাবের বিষয়টি উঠে আসে।
তিনি বলেন, বিমান যদি আগে থেকে এমন পরিকল্পনা করে যে, ফ্লাইটগুলো সৌদিতে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে দুবাই, শারজাহ বা কাতারের মতো আশপাশের দেশগুলোর যাত্রীদের ঢাকায় নিয়ে আসবে, তবে তারা যাত্রী সংকট কমাতে পারবে। কেন তারা এ পরিকল্পনা করে না? ফ্লাইটের ব্যয় মেটানোর জন্য এয়ারলাইন্সকে নানা কৌশল বের করতে হবে। নিরীহ যাত্রীদের ওপর অতিরিক্ত ভাড়া চাপিয়ে দিলে তো চলবে না।
কেবল বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্সকে হজযাত্রী পরিবহনের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখানে বিমান ও সৌদি এয়ারলাইন্স গত কয়েকবছর ধরে একটি সিন্ডিকেটের মতো করে রেখেছে বলা যেতে পারে। সাধারণত যেকোনো রুটে এয়ারলাইন্সগুলো পৃথক পৃথকভাবে ভাড়া নির্ধারণ করে। যখন একসঙ্গে একই ভাড়া নির্ধারিত হয়, তখন বুঝতে হবে এখানে কোনো সমস্যা আছে। এছাড়া বেসামরিক বিমান মন্ত্রণালয় ভাড়া নির্ধারণ করেছে। সেক্ষেত্রে সাউদিয়া চাইলেও কম ভাড়া নিতে পারবে না। বিমানকে প্রোটেক্ট করার জন্য (লোকসান কমানোর জন্য) সাউদিয়াকে বেশি ভাড়া নিতে একরকম উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
এআর/আরএইচ/জেএস