হালদার পানির গুণগতমান স্বাভাবিক, এবছর বাড়তে পারে ডিমের পরিমাণ
দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী। এ নদীর পানির ভৌত ও রাসায়নিক গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটারগুলো এখন আদর্শমানের ভেতরে রয়েছে। নদীর এমন অবস্থা ও অনুকূল পরিবেশ বজায় থাকলে এবছর অধিক পরিমাণে ডিম পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন হালদা নদীর গবেষকরা।
হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ডের পাঁচটি পয়েন্ট (অঙ্গুরীগোনা, নোয়াহাট, নাপিতেরঘাট, আজিমারঘাট ও রামদাসঘাট) থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করেছেন হালদা গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের প্রভাষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। পরীক্ষার পর পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে এসব কথা জানিয়েছেন হালদার ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা এ গবেষক।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৬ এপ্রিল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ডের পাঁচটি পয়েন্ট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করি। এরপর আমার নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখি। পরীক্ষা করে দেখতে পাই হালদার পানির প্রত্যেকটা প্যারামিটার আদর্শমানের মধ্যেই আছে। ১০টি প্যারামিটার নিয়ে কাজ করছি।
ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, স্পনিং গ্রাউন্ডের পানির ১০টি প্যারামিটারই আদর্শমানের মধ্যে আছে। কোনো প্যারামিটারই আদর্শমানের বাইরে যায়নি। বর্তমানে হালদার নদীর পানি দূষণমুক্ত আছে বলতে পারি। আর এই পানি হালদা নদীতে মা মাছের ডিম পাড়ার জন্য উপকারী।
তিনি বলেন, হালদা নদীতে ডিম ছাড়তে মা মাছ বজ্রপাত আর বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন মাসের যেকোনো পূর্ণিমা ও অমাবস্যার কয়েকদিন আগে-পরে জোয়ার ও ভাটার সময় মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হলে এই মাসের শেষের দিকে হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে। আর না হয় মে মাসে ডিম ছাড়তে পারে।
এই হালদা গবেষক বলেন, পানি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তা যদি বিদ্যমান থাকে ও প্যারামিটারগুলো যদি আদর্শমানের মধ্যে থাকে ডিম ছাড়া পর্যন্ত। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে যদি বৃষ্টি হয় ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকে তবে গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি ডিম পাওয়া যাবে।
এদিকে গত ১৬ এপ্রিল হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ডের অঙ্গুরীগোনা, নোয়াহাট, নাপিতেরঘাট, আজিমারঘাট ও রামদাসঘাট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করেন হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। পরীক্ষায় নদীর এ পাঁচটি পয়েন্টের পানির গড়মানে দেখা যায়— বর্তমানে হালদার পানির তাপমাত্রা ২৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস আছে, যার আদর্শমান ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পানির স্বচ্ছতা ৩৫ সেন্টিমিটার, এর আদর্শমান ১৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। তড়িৎ পরিবাহিতা পাওয়া যায় ১২১ মাইক্রোসিমেন্স/সেন্টিমিটার, এর আদর্শমান ৩৫০ মাইক্রোসিমেন্স/সেন্টিমিটার। টিডিএস পাওয়া যায় ৬০ পিপিএম, যার আদর্শমান ১ হাজার পিপিএম।
এছাড়া হালদার এ পাঁচটি পয়েন্টে পানির পিএইচ পাওয়া যায় ৭ দশমিক ৪ মাত্রায়, এর আদর্শমান মাত্রা হলো ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫। দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৫ দশমিক ৯ মিলিগ্রাম। এই মানের আদর্শ মাত্রা হলো প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু পানিতে অক্সিজেন যদি প্রতি লিটারে ২ মিলিগ্রামের নিচে নেমে যায়, তাহলে পানি দূষণ হয় বলে ধরা হয়। কিন্তু বর্তমানে করা পরীক্ষায় বোঝা যায় হালদার পানি এখন ভালো আছে।
পরীক্ষায় কার্বন ডাই অক্সাইড পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম। যা প্রতি লিটার পানিতে ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পাওয়া গেলে আদর্শমান মাত্রায় আছে বলে ধরা হয়। পানিতে ক্যালসিয়াম পাওয়া গেছে প্রতি লিটারে ৯ দশমিক ৬ মিলিগ্রাম, এই মাত্রার আদর্শমান ৩৬ মিলিগ্রাম। পানির খরতা পাওয়া গেছে লিটারে ৪৫ মিলিগ্রাম। এর আদর্শমান ২০০ থেকে ৫০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত। পানিতে ক্ষারকত্ব ৩৫ মিলিগ্রাম/লিটার মাত্রায় পাওয়া যায়, যার আদর্শমান ৫০০ মিলিগ্রাম/লিটার পর্যন্ত।
পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হচ্ছে লবণাক্ততার পরিমাণ, যা হালদা নদীতে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ পিপিটির কম মাত্রায় পাওয়া গেছে। এর আদর্শমান শূন্য দশমিক ৫ পিপিটি। অর্থাৎ হালদার পানিতে এখন লবণাক্ততা নেই।
গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, কোনো প্যারামিটারই তাদের রেঞ্জ অতিক্রম করেনি। প্যারামিটারগুলোর মান আদর্শমানের মধ্যে রয়েছে, যা হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্রের মাছ ও অন্যান্য জলজ জীবের জন্য উপযোগী। বলতে পারি হালদাতে কোনো প্রকার দূষণই নেই।
হালদার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২১ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজি। ২০২০ সালে ছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। এর আগের বছর অর্থাৎ, ২০১৯ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কেজি।
কেএম/এসএসএইচ