অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছি না, আক্ষেপ পুলিশ কর্মকর্তার
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকায় বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে সরকার। খুলেছে দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানও। সড়কে শুরু হয়েছে পুরোদমে যান চলাচল। এ অবস্থায় প্রতিদিনই যানজটে নাকাল হতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। এমন কোনো দিন নেই রাজধানীতে যানজট কিংবা যানবাহনের দীর্ঘ সারির দেখা মেলে না। যানজট নিয়ন্ত্রণে নানা চেষ্টার পরও বিশেষ কিছু করতে না পারায় আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের এক কর্মকর্তা।
আজ সকাল থেকে রাজধানীতে তীব্র যানজট। তার মধ্যে মাথার উপর সূর্যের চোখ রাঙানি। তাপমাত্রাও ছাড়িয়েছে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একদিকে তীব্র যানজট তার ওপর গরম, দুই মিলে ত্রাহি অবস্থা নগরবাসীর।
ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তাদের দাবি, রাজধানীর অসহনীয় যানজটের মূল কারণ তিনটি। প্রথমত, নগরজুড়ে উন্নয়ন প্রকল্পের খোঁড়াখুঁড়ি। দ্বিতীয়ত, দুই বছর পর স্কুল-কলেজসহ খুলেছে সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। তৃতীয়ত, আগের তুলনায় বেড়েছে যানবাহন, বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। যা যানজটের তীব্রতা বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। মোটা দাগে এ তিনটি কারণেই রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে প্রতি ২ বছর অন্তর ফিটনেস নবায়নের নিয়ম রয়েছে। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬ হাজার ৪১৩টি এবং ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭ লাখ ৫০ হাজার ৭২২টি যানবাহনের ফিটনেস সার্টিফিকেট ইস্যু ও নবায়ন করেছে বিআরটিএ। বাকি যানবাহন ফিটনেসই নবায়ন করেনি। যা রাজধানীতে চলছে অবৈধভাবেই।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী ঢাকায় রেজিস্ট্রেশন করা মোটরযানের সংখ্যা ১৮ লাখ ১০ হাজার ২৭৫টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা মাত্র ৩৭ হাজার ৫৯৩। ২০২০ সালে ১৭৯২টি বাস রেজিস্ট্রেশন পায় আর ২০২১ সালে পায় ১২১৩টি, চলতি বছরের দুই মাসে মাত্র ২৫১টি বাস রেজিস্ট্রেশন করেছে।
তবে বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত পরিবহনকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ। বর্তমানে ঢাকায় রেজিস্ট্রেশন করা প্রাইভেটকারের সংখ্যা ৩ লাখ ১৭ হাজার ৫০৯টি। এর মধ্যে ২০২০ সালে রেজিস্ট্রেশন পায় ১১ হাজার ১৫০টি, ২০২১ সালে ১৪ হাজার ৩২১টি। আর চলতি বছরের দুই মাস অর্থাৎ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেই বিআরটিএ রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে ২ হাজার ৭২৪ প্রাইভেটকারের।
যদিও রাজধানীতে বাড়েনি সড়ক, উল্টো উন্নয়ন ও সেবার নামে বছরজুড়েই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এতে মূল সড়কও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সড়কে অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে ব্যাহত হচ্ছে যান চলাচল, বাড়ছে যানজট।
ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীর বিমানবন্দর, উত্তরা, তেজগাঁও, আড়ং-গুলশান লিংক রোড, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, মিরপুর, কালশীসহ অসংখ্য স্থানে ছোট বড় উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। এ জন্য চাইলেও সড়কে যান চলাচলে গতি বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তাই তৈরি হচ্ছে যানজট। যা সময়ের ব্যবধানে বাড়ছে বৈ কমছে না।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত রাজধানীর তেজগাঁও ও গুলশান এলাকা ঘুরে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করেন এ প্রতিবেদক। আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গীর গেট পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের তীব্র চাপ ছিল। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির চাকা। যানবাহনের দীর্ঘ সারি পেরিয়ে মহাখালী ফ্লাইওভারে উঠতেই বদলে যায় চিত্র। ওয়ান ওয়ে হওয়ায় পুরো সড়কে দ্রুত গতি পায় যানবাহনগুলো। তবে উত্তরা গিয়ে আবারও উন্নয়নযজ্ঞের খোঁড়াখুঁড়িতে আটকে যাচ্ছে যানবাহনের গতি।
রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের চালক মেহেদি হাসান বলেন, আজকের অবস্থা ভয়াবহ। সাধারণত সড়কে যানজট থাকলেও বিভিন্ন গাড়ির পাশ দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু আজ সে পরিস্থিতিও নেই। ঠায় বসে আছি। জাহাঙ্গীর গেট পার হওয়ার পর আবিষ্কার করলাম বিএএফ শাহীন স্কুল খোলা। ছাত্র-ছাত্রীদের নিতে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ সেখানে। যার প্রভাব পড়েছে ফার্মগেট ও আগারগাঁওয়ের সড়কেও।
একই দৃশ্য রাজধানীর মিরপুর-১০, শ্যামলী, খামারবাড়ি, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও মগবাজারেও। একদিকে তীব্র যানজট তার ওপর কড়া রোদের তাপ। দুইয়ে মিলে অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে।
ইকবাল মাহমুদ নামে এক বাস যাত্রী বলেন, মিরপুর-১০ থেকে মগবাজার পৌঁছাতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগেছে। এর মধ্যে ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আজ। বাসে বসে বসে যাত্রীদের ক্ষোভ প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করার নেই।
যদিও অন্যান্য এলাকার তুলনায় গুলশান এলাকার দৃশ্য তুলনামূলক ভালো। তবে সেখানেও ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেড়ে যায় অফিস টাইমে।
গুলশান ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গুলশানেও যানবাহনের প্রচণ্ড চাপ। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা এখানে বেশি। একেকটি ছাত্রের জন্য একেকটি ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ সামাল দিতে হয় আমাদের। গুলশানের ভেতরে ব্যক্তিগত গাড়ির চাপ বেশি। মূল সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে গণপরিবহন তো আছেই। তবে গুলশানের অবস্থা ভালো এ কারণে যে এখানে অন্তত খোঁড়াখুঁড়ির চাপ নেই। রাস্তাও ভালো। শুধু অফিস টাইমে (সকাল ও বিকেলে) চাপ বেশি থাকে।
তবে অনেকটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠল তেজগাঁও ট্রাফিক বিভাগের উপ-কমিশনার সাহেদ আল মাসুদের কথায়। তিনি বলেন, যানবাহন বেড়েছে, স্কুল কলেজও খুলেছে। আমরা শুরুতে মোটরসাইকেল নিয়ে ভয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ব্যক্তিগত যানের সংখ্যাই বেশি। তেজগাঁও এলাকায় ফুটপাত ফাঁকা। রিকশাও চলে না। এরপরও দেখা যাচ্ছে গাড়ি চলছে না। একটা লেন চালু রাখলে বাকি তিনটা বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সবাই অতিষ্ঠ। আমরা অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারছি না। গত কয়েক বছরে রাজধানীতে রাস্তার সংখ্যা কিংবা প্রশস্ততা বাড়ার বিপরীতে কমেছে। আবার পরিবহনের সংখ্যা বেড়েছে। ঢাকায় যদি যানবাহনের সংখ্যা কমানো না যায় তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
আজকের যানজটকে নজিরবিহীন বলছেন বাসচালকরা
রাজধানীর কমলাপুর থেকে টঙ্গীগামী বিআরটিসির বাসটি ছেড়েছিল সকাল সাড়ে ৭টায়। বেলা পৌনে ১১টার দিকে ফার্মগেট ছাড়িয়ে বিজয় সরণির সিগন্যালে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাসের সহকারী মো. নাসির বিরক্ত হয়ে বলেন, অন্য দিন দেড় ঘণ্টার মধ্যে এখানে আসা যায়। আজ তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেল। ‘যানজট আইজ হিসাব ছাড়া।’
সাভার থেকে আসা গুলশান নতুন বাজার রুটে চলাচলকারী বৈশাখী পরিবহনের চালক সামশুর রহমান বলেন, আগারগাঁও থেকে মহাখালী পর্যন্ত বাইপাস রোডে সকালে চাপ থাকলেও সাধারণত যানজট থাকে না। সে দৃশ্য যেন দুই সপ্তাহ ধরে বদলে গেছে। আগারগাঁও থেকে নতুন বাজার পৌঁছাতে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগছে। আজ তো কোনো হিসেবই মিলছে না।
জেইউ/এসকেডি