বদলাচ্ছে মানসিকতা, সফলতার গল্পও অনেক
কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ সহজ নয়। এখনও দৈন্য রয়ে গেছে মানসিকতায়। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কম-বেশি সবক্ষেত্রে নারীদের প্রতি হয়রানি ও সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। একজন পেশাজীবী নারীকে ‘মা’ হিসেবে কিংবা ‘স্ত্রী’ হিসেবে পুরুষের চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হয়। পেশাগত জায়গাতেও দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ হিসেবে বেশি কাজ করতে হয়।
এক দিনে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে আদর্শিক বা মূল্যবোধের জায়গা থেকে পরিবর্তন না এলে এ থেকে নারীর মুক্তি নেই। রোববার নিজ কার্যালয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক লালবাগ বিভাগের সহকারী কমিশনার জয়ীতা দাস।
৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে নারীর ক্ষমতায়ন, পদায়ন, যোগ্যতা, নারীর উন্নয়ন, কর্মক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতা, বৈষম্য এবং নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি। পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ পুলিশে নিজেকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
জয়ীতা দাস : বাংলাদেশ পুলিশে আমার পদ-পদবি এবং আমার ওপর অর্পিত সব দায়িত্ব পালনে নিজের সামর্থ্য ও আন্তরিকতার সর্বোচ্চটুকু দিয়েই কাজ করার চেষ্টা করি। কারণ আমি মনে করি, সব সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে আমি এ মহান প্রতিষ্ঠানের একজন গর্বিত সদস্য।
ঢাকা পোস্ট : অনেক পেশা থাকতে পুলিশেই কেন এলেন?
জয়ীতা দাস : পরিবারের স্বপ্ন ছিল মেয়ে ডাক্তার হবে। কিন্তু মেডিকেলে আমার পড়া হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ না করতেই আমার সিভিল সার্ভিসে যোগদানের ডাক আসে। অ্যাপিয়ার্ড দিয়েই বিসিএসে অংশ নিয়েছিলাম। মেডিকেলে পড়তে পারিনি বলে পড়াশোনায় প্রত্যয়ী ছিলাম। পুলিশে সুযোগও মেলে। মা-বাবা ডাক্তার না হওয়ার আক্ষেপের চেয়ে বেশি তৃপ্ত হন মেয়েকে পুলিশের ইউনিফর্মে দেখে। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সেবা করার যে সুযোগ আমি পেয়েছি পুলিশ সদস্য হিসেবে, সত্যিই আমি গর্বিত। এটা এখন আমি উপভোগ করছি।
ঢাকা পোস্ট : পুলিশে আসার পেছনে কার বেশি অবদান রয়েছে?
জয়ীতা দাস : বাবা-মা সবসময়ই চাইতেন সন্তান হিসেবে আমরা যেন প্রতিষ্ঠিত হতে পারি, স্বাবলম্বী হতে পারি। সে লক্ষ্যে হাতেখড়ি থেকে শুরু করে শিক্ষাজীবনের শেষ পর্যন্ত তারা ছায়ার মতো আমার পাশে থেকেছেন। আর পুলিশ সার্ভিসের প্রতি বা ইউনিফর্মের প্রতি আমার নিজের বিশেষ এক ধরনের দুর্বলতা ছিল। এক্ষেত্রে আমাকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহ যিনি দিয়েছেন, তিনি আমার বড় বোন।
ঢাকা পোস্ট : পরিবার সামলে পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় কাজ করছেন। সবকিছু একসঙ্গে সামলানো কতটা কঠিন বলে মনে করেন?
জয়ীতা দাস : পেশাগত জীবনের বাইরে আমি একজন স্ত্রী ও একজন মা। সংসার ও পেশা একসঙ্গে সামলানো সত্যিই অনেক কঠিন। তবে আমি মনে করি, এক্ষেত্রে একজন নারীর জন্য দুটোই অনেক সহজ হয়ে যায় যদি পাশে স্বামী ও পরিবার থাকে। এখন পর্যন্ত আমি সবকিছু সুন্দরভাবে সামলে নিতে পারছি শুধুমাত্র পরিবারের নিরবচ্ছিন্ন মানসিক সাপোর্ট ও আন্তরিক সহযোগিতার জন্য।
ঢাকা পোস্ট : ট্রাফিকে নারীদের জন্য কাজ করা কতটা কঠিন বলে মনে করেন? এখানে নারীদের জন্য অপরিহার্য কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী ?
জয়ীতা দাস : নিঃসন্দেহে মাঠপর্যায়ে কাজ করা কঠিন। এর মধ্যে ট্রাফিক বিভাগের কাজ তো আরও বেশি কঠিন। তবে আমি নিজেকে নারী হিসেবে মনে না করে পুলিশের একজন গর্বিত সদস্য হিসেবেই চিন্তা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কিছু সমস্যা তো নারী হিসেবে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে থেকেই যায়। টানা আট ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ডিউটি করাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। বিটভিত্তিক কিছু সুযোগ-সুবিধা যদি যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আরেকটু আন্তরিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া যায়, তবে ট্রাফিকের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজেও নারীদের অংশগ্রহণ আরও স্বতঃস্ফূর্ত হবে।
ঢাকা পোস্ট : নারী ট্রাফিক কর্মকর্তা হিসেবে সড়কে আপনাকে কাজ করতে হয়। নারী বলে তিক্ত কোনো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন কি?
জয়ীতা দাস : না, এখনও এমন কিছু ঘটেনি। আসলে ইউনিফর্ম সার্ভিস তো, সেই কারণে অন্য কোনো প্রফেশনের চেয়ে নিজেকে বেশি নিরাপদ মনে করি।
ঢাকা পোস্ট : পুলিশে নারীর অগ্রগতি বা কাজের স্বীকৃতি সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন কী?
জয়ীতা দাস : এখন নারীরা কোথায় কাজ করছেন না— আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে শুরু করে দেশের ভেতরে পুলিশের সব ইউনিটেই নারী সদস্যরা অত্যন্ত পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। শান্তিরক্ষা মিশনের মতো আন্তর্জাতিক ফোরামেও বাংলাদেশের নারী পুলিশ সদস্যরা কাজ করছেন। তারা ভূয়সী প্রশংসা ও পুরস্কার অর্জন করছেন। আমি বলব, নারী পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনেক বেশি আন্তরিক। অনেক ক্ষেত্রে অযোগ্যতা যেন প্রকাশ না পায়, সেজন্য নারীরা দ্বিগুণ কাজ করেন এবং তাদের কর্মদক্ষতা দেখান।
ঢাকা পোস্ট : পুলিশে নারী সদস্যের প্রতি সহিংসতা বা যৌন হয়রানির অনেক অভিযোগ আসে, যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশ পায় না। কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
জয়ীতা দাস : সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সব সেক্টরেই নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। নারীর সামাজিক মর্যাদা হেয় হবে ভেবে অনেকেই চুপ থাকেন। এটা এক দিনে নিরসন সম্ভব নয়। প্রতিটি স্তরে আদর্শিক বা মূল্যবোধের জায়গা থেকে পরিবর্তন আনতে হবে। তা না এলে নারীর মুক্তি নাই।
ঢাকা পোস্ট : সার্বিকভাবে বাংলাদেশের নারীদের আরও এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয় বলে মনে করেন? কতটা বদলেছে নারীবিরোধী মানসিকতা?
জয়ীতা দাস : আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে নারীর প্রতি আস্থার অভাব। কিন্তু দেখুন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকারও নারী। তারা কি তাদের কর্মক্ষেত্রে সফল নন? আমি খুব কমই শুনেছি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো নারী যেকোনো পেশাতেই হোক না কেন, সফল হননি। আস্থার জায়গাটা এখানে লালন করতে হবে। নারীদের এগিয়ে নিতে হবে, আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে। নারীবিরোধী মানসিকতা যদিও অনেকটা বদলেছে। ফলে এখন আমরা বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের সুন্দর সুন্দর সফলতার গল্প শুনতে পাচ্ছি।
চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা জয়ীতা দাসের জন্ম সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে। ২০০৬ সালে এসএসসি ও ২০০৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে স্নাতক চূড়ান্ত বর্ষের পরীক্ষা দিয়েই বিসিএস পরীক্ষার জন্য আবেদন করেন। পুলিশে যোগ দেন ২০১৭ সালে। ট্রেনিং শেষে শিক্ষানবিশকাল পার করেন ময়মনসিংহে। এরপর যোগ দেন ডিএমপির উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে। বর্তমানে তিনি লালবাগ ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার হিসেবে দায়িত্বে আছেন। বাবা অজয় কুমার দাস স্কুলশিক্ষক, মা নুপুর দাস গৃহিণী। চার বোনের মধ্যে দ্বিতীয় জয়ীতা। বড় বোন ব্যাংকে চাকরি করেন। ছোট দুই বোন পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এক সন্তানের জননী জয়ীতার স্বামী সুজন রয়ও ব্যাংকার।
জেইউ/আরএইচ