ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় নিয়ে ২১ বছর কাটল নাম-পেশা বদলে
২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে বোমা হামলার মাধ্যমে হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি আজিজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ। ওই মামলার ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ছিলেন আজিজুল।
সিটিটিসি বলছে, আজিজুল হক দীর্ঘ ২১ বছর নানা পেশায় ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনে ছিলেন। অত্যন্ত গোপনে চালিয়ে আসছিলেন সাংগঠনিক কার্যক্রমও। তিনি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে টেইলারিং, মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, গাড়ি চালক এবং সবশেষ প্রিন্টিং ও স্ট্যাম্প প্যাড বানানোর কাজ করে আসছিলেন। কখনো রোমান, কখনো শাহনেয়াজ নামে নিজের পরিচয় দিতেন তিনি।
বুধবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিসিটিসি প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান।
তিনি বলেন, গতকাল মঙ্গলবার (১ মার্চ) রাজধানীর খিলক্ষেত থানাধীন খিলক্ষেত বাজারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে একটি মসজিদের সামনে থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা মামলায় ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আজিজুল হক রানা ওরফে শাহনেওয়াজ ওরফে রুমানকে (৪৪) গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে জিহাদি বই, ২টি মোবাইল ফোন, পেনড্রাইভ ও কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করা হয়। আজিজুল হক রানার বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, ২০০০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান সরকারি আদর্শ কলেজ মাঠে অবস্থিত সভামঞ্চের পাশে মাটির নিচে একটি ৪০ কেজি ওজনের বোমা এবং হেলিপ্যাডের (ডহর পাড়া) পাশে মাটির নিচে একটি ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়। আজিজুল হক রানা মুফতি হান্নানের সঙ্গে বোমা পুঁতে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। ঘটনাটি প্রকাশ পেলে বোমা দুইটি উদ্ধারের পর আজিজুল হক ওরফে শাহনেওয়াজ কোটালীপাড়া থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে।
গ্রেপ্তারের পর আজিজুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সিটিটিসিকে জানিয়েছেন, তিনি ১৯৮৭ সালে গাজীপুরের শ্রীপুরে জামিয়া আনোয়ারিয়া মাদরাসায় নূরানী বিভাগে ভর্তি হন। ওই মাদ্রাসার ওস্তাদ ও হরকাতুল জিহাদের সক্রিয় সদস্য মুফতি হান্নানের অনুসারী মাওলানা আমিরুল ইসলামের সংস্পর্শে আসেন। আমিরুল ইসলাম তাকে হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করেন। ওই মাদরাসায় মুফতি হান্নান, আব্দুর রউফ, আব্দুস সালামসহ হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের সিনিয়র সদস্যদের যাতায়াত ছিল এবং হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ (হুজিবি) সদস্যরা ওই মাদরাসায় গোপন বৈঠক মিলিত হতেন।
গ্রেপ্তার আজিজুল হক হুজিবিতে যোগদানের পর অন্য ছাত্রসহ প্রশিক্ষণ ও তালিম নেওয়ার জন্য হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি ইজহারের চট্টগ্রামের লালখান মাদরসায় যায় এবং তালিম গ্রহণ করেন। তালিম শেষে সেখানে তিনি বোমা তৈরি, আত্মরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুফতি হান্নান সংগঠনের অপারেশনাল কার্যক্রমের জন্য জিহাদি বিশ্বস্ত কয়েকজন লোক সংগ্রহ করার জন্য মাওলানা আমিরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেন। মাওলানা আমিরুল আজিজুল হককে নির্বাচন করেন।
আমিরুল ইসলাম তাকে একটি পত্র লিখে দিলে পত্র সহকারে গোপালগঞ্জ বিসিক এলাকায় সোনার বাংলা সাবান ও মোমবাতি তৈরির কারখানায় পাঠায় এবং মুফতি হান্নানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে মাওলানা আমিরুল ইসলামের দেওয়া পত্রটি দেয়। মুফতি হান্নান তাকে সংগঠনের নিয়মকানুন সম্পর্কে বুঝিয়ে দেন এবং আজিজুল হকের নাম পরিবর্তন করে ছদ্মনাম ‘শাহনেওয়াজ’ দেন।
আজিজুল হক নতুন নাম শাহনেওয়াজ পরিচয়ে আনুমানিক ১৫ দিন মোমবাতি প্যাকিংয়ের কাজ করেন। বিশ্বস্ততা অর্জন করলে কারখানার পেছনে একটি কক্ষে গোপন বৈঠকে উপস্থিত থাকার অনুমতি পান। কারখানায় মোমবাতি ও সাবান তৈরির আড়ালে বোমা তৈরির কাজ চলত। বোমা তৈরির কাজে আজিজুল হকসহ মো. ইউসুফ ওরফে মোসহাব, মেহেদী হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ, ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক হোসেন, মহিবুল ওরফে মফিজুর রহমান, শেখ এনামুল হক, আনিসুল ইসলাম ওরফে আনিসসহ আরও কয়েকজন জড়িত ছিলেন।
২০০০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সফরসঙ্গীদের হত্যার উদ্দেশ্যে পুঁতে রাখা বোমা উদ্ধারের পর আজিজুল পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। মাওলানা আমিরুলের সঙ্গে দেখা করেন।
দীর্ঘ ২১ বছর একটি চাঞ্চল্যকর মামলার আসামি জঙ্গি সদস্য কীভাবে পালিয়ে থাকতে সক্ষম হলেন, এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান বলেন, এটা ব্যর্থতা নয়, সফলতা। ছদ্মবেশ ধারণ করে নিজেকে আত্মগোপনে রেখেছিলেন তিনি।
ছদ্মবেশ ধারণ করে ২১ বছর আত্মগোপনে
আজিজুল হক দীর্ঘ ২১ বছর বিভিন্ন ছদ্ম পেশার আড়ালে নিজেকে আত্মগোপন রেখে অত্যন্ত গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলেন। আজিজুলসহ ওই মামলার পলাতক আসামিকে গ্রেফতারে সিটিটিসি দীর্ঘ সময় তদন্ত ও অভিযান পরিচালনা করে আসছিল। তিনি ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করতেন। দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনি অবস্থান করেছেন। আজিজুল নিজেকে লুকিয়ে রাখতে টেইলারিং, মুদি দোকানদার, বই বিক্রেতা, ড্রাইভার এবং সবশেষ প্রিন্টিং ও স্ট্যাম্প প্যাড বানানোর কাজ করেছেন। দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য তিনি পাসপোর্টও করার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ধরা পড়ার আশঙ্কায় পাসপোর্ট করা থেকে বিরত থাকেন। রোমান নামে তিনি নেত্রকোনা থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স করেন।
আজিজুল বোমা তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন পাশাপাশি সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন, এ অবস্থায় তিনি বোমা তৈরির কৌশল অন্য কাউকে শিখিয়েছেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাকে কালকেই গ্রেপ্তার করেছি। তাকে আমরা এসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করব। তিনি হুজিবিকে রিফর্ম করার চেষ্টা কিংবা নতুন কাউকে বোমা তৈরির কৌশল শিখিয়েছেন কি না, এসব বিষয় জানতে নতুন মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হবে।
আজিজুল গ্রেফতার হলেও এখনো পলাতক চারজন
শেখ হাসিনাকে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা হামলার মাধ্যমে হত্যা চেষ্টা মামলার আসামি আজিজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হলেও এখনো আরও চারজন পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন, মো. লোকমান, মো. ইউসুফ ওরফে মোছহাব মোড়ল, মোছহাব হাসান ওরফে রাশু, শেখ মো. এনামুল হক।
জেইউ/এসকেডি