বিবশ
এক.
আমাদের আব্বা বড্ড নিশ্চুপ। চুপচাপ-চাপা স্বভাবের। সারাদিনে তিনটা শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হয় না। অন্যদিকে আম্মা কথার খই ফোটান। তার সংসার, সংগ্রাম, সীমাহীন দুঃখ এসব। এক রথে একাকী বয়ে চলা জীবনের ঘানি। বাপের বাড়ির রকমারি কেচ্ছা, ছোটবেলায় মা-খালাদের সাথে করা হরেক কাহিনির গপসপ। আমাদের মামারা কেউ বোনের খবর নেয় না। এরপরও সন্ধ্যা করে, নানা কথা শেষে বাপের বাড়ির মরা বাপ-মায়ের জন্য, ভাইদের জন্য কান্নাকাটি করা তার একরকম রুটিন কাজ।
ছোটবেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মরা সাত বছরের ভাইয়ের জন্য মায়ের ভেতরে, থেকে থেকে দরদ উছলে উঠে। ছটকু ছটকু বলে বিলাপ শুরু করেন তিনি। জানি না, আম্মার এ কান্না কখনো তার স্রষ্টার মন ছুঁয়ে যায় কি না। তবে এতটুকু বুঝি, এমন কান্না হয়ে গেছে এক প্রৌঢ়ার জীবনের রোজকার নিয়তি।
আম্মা মাঝেমধ্যে মাগরিবের নামাজের পর জায়নামাজে দুইপা ছড়িয়ে বসেন। তারপর এক নাগাড়ে কথকতা বলে যান। আব্বা তখনো নিশ্চুপ। পরেও চুপ। আমাদের বাবা-মায়ের এমনই এক বন্ধন। আম্মা বলে যান আর আব্বা শুনে যান। আমাদের দেখতে দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে। আমাদের মা-বাবা এক আত্মায় লীন দুটি দেহ। আমার মায়ের পছন্দই আমার আব্বার পছন্দ। আমার আম্মা তাই তাই পছন্দ করেন যা যা আব্বার পছন্দের। আমাদের আব্বা মা অন্তঃপ্রাণ। আর আব্বা হলেন মায়ের প্রাণ। আব্বার সাহস নেই কখনো আম্মার কথার বাইরে যায়। আম্মাও আব্বাকে অস্থির দেখে স্থির থাকতে পারে না।
দুই.
আগে কখনো খেয়াল করিনি। আম্মা দুনিয়ার কাহিনি বলে যান ঠিকই কিন্তু সেসবের কোথাও ‘তিনি’ মানুষটা নেই। তার সব কথা সংসার, সন্তান, স্বজন-এসব নিয়ে। সংসারের অভাব নিয়ে তার মনে দুঃখ আছে। ছেলেটা ফিরনি খেতে চাইল, ঘরে চাল ও চিনি না থাকার হা-হুতাশ আছে। আশ্বিন মাসে ওঠা নয়া ধান নিয়ে আশা ও আশঙ্কার কথা। দেখতে কালো বলে আপার বিয়ে কোথায়, কীভাবে হবে, বিয়ের খরচ কে জোগাবে এসব হাবিজাবি। আব্বা মায়ের কথা শুনেন আর মুচকি মুচকি হাসেন।
সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। গাই দুধ দেয়নি বলে কোনো এক সকালে মায়ের মন খারাপ হয়ে যায়। ছেলে-মেয়েদের আজ দুধ খাওয়াতে না পারার দুঃখ ভোলার কী যে চেষ্টা থাকে মায়ের। তিনি রাস্তা থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে রাস্তায় আসতে-যেতে হাপিত্যেশ করেন। রাস্তার ধারে পুরোনো খালের ওপরে চালা দিয়ে লাগানো লাউ গাছে লাউ দেখেন। লাউয়ের কচি পাতা খুঁজেন। খোঁয়াড়ে গিয়ে হাঁসের ডিম গুনেন। নয়া খালের মুখে পাতা আনতায় মাছ উঠল কি-না দেখে আসেন। লাউয়ের কচি ডগা দিয়ে ডিম ভুনা আর কুমড়ো ফুলের বরা আব্বা ও আমার ভীষণ প্রিয়। আম্মা যেন আমাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করেন।
আমি খুব লাজুক আর চাপা স্বভাবের ছিলাম বলে আমাকে নিয়ে তার বিশেষ ভয় ছিল। এতদিনেও সেই ভয় কাটেনি। আমাকে আলাদা করে একটা ডিম সিদ্ধ দিয়ে বলতেন, দরজায় চিপায় দাঁড়িয়ে তাত্তারি খাইয়া পানি খা। মুখে ঢুকাইয়া ওপ করে থাকবি না বলে শাসাতেনও। এখনো তার মুখে হাতাশার সুর শুনি দিনান্তে—‘তোর মুখে কথা ফুটবে আর কবে! তুই কবে নিজের বালাডা বুজবি!’ আম্মা মুখখানি কালো করে বলে যান।
আমার আম্মা, ছেলে-মেয়েরা দুধ খেতে পারেনি বলে, বহুদিন তারা ভালো কিছু খায় না বলে হাপিত্যেশ করেন। তবে তাকে কখনো দুধের গ্লাসে মুখ দিতে দেখা যায় না। আমরা ভাই-বোনেরা কখনো খোঁজও নেয়নি—মা কী খান, কীভাবে তার দিন চলে, তার মনে কোন ব্যথার বীণ বাজে। পুরো সংসারের ঘানি টানতে টানতে মায়ের দেহটা কতটা ক্লান্ত তা তলিয়ে দেখার ইচ্ছা বা বুঝ কোনোটাই হয়তো আমাদের ছিল না, আসলে এখনো নেই।
সন্তানের কাছে মা-বাবার অবসাদ বোঝার সময় কোথায়? আমাদের কথা কেবলই আমাদের যা যা প্রয়োজন তা তা নিয়ে। আমাদের দেখার চোখ আমাদের নতুন পোশাক বা শখের জিনিসের বাইরে আর কোথাও যায় না। গেলে মায়ের মলিন-ছেঁড়া কাপড় দেখে আমাদের অনুশোচনায় ভোগার কথা। আমাদের ভাবনায় কখনো আসেনি, বাবার পায়ের জুতা সেলাই হতে হতে আর সুই ফেলার জায়গা অবশিষ্ট নেই। বাবা-মা’দের কি তবে নতুন কিছুই লাগে না!
আমাদের আব্বাও কম যান না। মাঝেমধ্যে তিনি দুধের গ্লাস রেখে দেন। এরপর মিনমিনে গলায় বলেন-কী যে ঠেকল গলায়। বমি আসতেছে। আজ আর দুধ খাওয়া হবে না। তিনি মুখে হাত ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করেন। আব্বার ফেলে দেওয়া দুধ আম্মা খান। জানি না এভাবে আম্মাকে ফাঁকি দিয়ে আমার আব্বাজান কি শান্তিইবা পান। আম্মাও কি আব্বার এসব চালাকি দেখে মনে মনে হাসেন! কে জানে?
তিন.
আমার মাকে কখনো বলতে শুনিনি, তার শাড়ি নেই, পায়ের জুতা ছেঁড়া বা তার এক জোড়া কানের দুলের খুব শখ। এক নাকফুল ছাড়া আর কিছু কোনোদিন তাকে পরতেও দেখিনি। লিপস্টিক জিনিসটা আমার মায়ের চেনার কথা না। সাজুগুজু ব্যাপারটাও ঠিক বুঝেন বলে মনে হয় না। হয়তো বোঝার ফুরসৎ সেভাবে পাননি।
ছোটবেলায়ও তাকে কখনো সাজতে দেখিনি। হয়তো মনে মনে স্বাদ থাকলেও সাজার আয়োজন থাকে না। সাজ সাজ আনন্দের উপলক্ষও সেইভাবে আসেনি কখনো। দুই ঈদে আমরা যখন আনন্দের হাঁট খুলে বসতাম, আম্মার তখন আমাদের আনন্দ রসদ জোগাতে জোগাতেই জীবন জেরবার। ফলে হাসার সময় তার ছিল না, সাজার তো না-ই। তবু তিনি তার মতো সুন্দর, সজীব ও চাঞ্চল্যে ভরপুর এক উচ্ছল রমণী। তিনি কখনো কারও কাছে ভালো খাবার খেতে চাননি।
পড়শী বাড়ির পুলিশের বউয়ের সাথে নিজের তুলনাও টানেননি। ছেলে-মেয়ের মুখগুলো যেন ভাড়া নিয়েছিলেন নিজের মুখে আব্বাকে শোনাবেন বলে। বড় ছেলের জুতা দরকার তো, ছোট মেয়ের একটা নতুন কামিজ হলে ভালো হয়। ডিম বেচে জমানো তিনশ টাকার সাথে আর ক’টাকা যোগ করলে ছোট ছেলের স্কুলের ড্রেস হয়ে যায়, সে হিসাব কষতেন। আর এক নাগাড়ে নানান কথা বলে যেতেন। আব্বা তখনো চুপ, তার মতো। যেমনটা ছিলেন সারাটা জীবন ধরে। আমরা চার ভাই-বোন হলাম আমাদের বাবা-মায়ের নয়নের মণি, আমাদের মা-বাবার আনন্দের খনি।
চার.
মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই জ্বরে কাতর হন আম্মা। আব্বা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করেন। উঠানটা ঝাড়ু দিতে চান, হাস মুরগিগুলো ছাড়তে যান, হয়তো রান্নাবান্নাও করবেন। আমাদের বলতেন তোমাদের আম্মার শরীর খারাপ। আজ তাকে জ্বালাইও না। নিজে নিজে ভাত বেড়ে খাও। ছোট ভাইটা ঝগড়াটে বলে, এখানে সেখানে গ্যাঞ্জাম করে বলে তাকে আব্বা নিজেই খাওয়ান।
মায়ের অসুখ শুনলে ভাইটা কেমন যেন চুপসে যায়। আমাদের দিকে মুখ কালো করে তাকায়। তারপর বাড়ির বাইরে এক ছুট। আমাদের জানাই ছিল না, মায়েদেরও অসুখ হয়। তাদেরও আমাদের মতো বিশ্রাম নিতে হয়। এখনো কি আসলে বুঝত পারি যে মা’রা বুড়ো হলে তাদেরও সেবার প্রয়োজন হয়। বুঝলে এতো আবদার কি করে মায়ের উপর দিব্যি চাপিয়ে দেয়? ছোটবেলায় আব্বার ছোটাছুটি দেখে আমি বেশ মজা পেতাম। বড় আপা অবশ্য আব্বার আশপাশে থাকত। এটা সেটা এগিয়ে দিত। আব্বা হয়তো আম্মাকে ছাড়াই কিছু একটা করে ফেলত।
কিন্তু মায়ের ধ্যাতানির ভয়ে আব্বার আর কিছুই করা হয়ে উঠে না। আব্বা তবু মায়ের ছায়ার পেছন পেছন হাঁটেন। আমাদের আব্বা আম্মার ভয়ে তটস্থ। আর আম্মা ছিলেন আব্বাকে এভাবে, তার মতো করে ভালোবেসে অভ্যস্ত। তারা তাদের নিজেদের মতো করে বুঝে গিয়েছিল। এজন্যই হয়তো এতো না থাকার মাঝেও তাদের আছে সুখময় এক দাম্পত্য জীবন। আমরা পেয়েছি জান্নাতি পিতা-মাতা, ভাইবোনদের কলকাকলি, খুনসুটি আর স্নেহ-ভালোবাসায় ভরা শৈশব। আমাদের বিত্তের বৈভব ছিল না ঠিকই কিন্তু সুখের কোনো কমতি ছিল না। এখনো নেই।
পাঁচ.
ছোটবেলায় রান্নাবাড়া শেষে আম্মা পাটি বিছিয়ে আমাদের বসতে দিতেন। কখনো কখনো আমরা গোল হয়ে পিঁড়িতে বসতাম। তারপর খাবার বেড়ে দিয়ে সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকাই ছিল তার চোখের শান্তি। এখনো আমরা এভাবেই বসে খাই। আমরা খেয়ে চলে গেলে, আমাদের বাসি খাবার থাকলে সব খাওয়া এখনো মায়ের রুটিন কাজ।
আব্বা তখনো বসে। আম্মার খাওয়া শেষ হলেই কেবল আব্বার খাওয়া শেষ হয়। রাতের খাবার শেষে উঠানে পাতা পাটিতে বসে আসমানের দিকে তাকিয়ে থাকেন আব্বা। পাখি দেখেন, নাকি জোনাকি পোকা গুনেন কে জানে। নাকি নিজের সব অভিযোগ, অনুযোগ আসমানের উনাকে বলেন! আমাদের কখনো জানা হয়নি। তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না, আকাশের সাথে আমার বাবার আছে এক গভীর সংযোগ, তারারা যেন তার চির আপন। থেমে থেমে হাত পাখা চালান আর আনমনা আকাশের পানে তাকিয়ে থাকেন। যেন, বাউলা বাতাস আউলা চুলে লাগলো দোলা/গান ধরেছে পথের ধারে আত্মভোলা।
আম্মা আব্বার জন্য পানের বাটা নিয়ে পাশে এসে বসেন। আব্বা বালিশ পেয়ে হেলান দেন। আম্মা আব্বার হাত থেকে পাখাটা টেনে নিয়ে কথা শুরু করেন। আব্বা এবার পান চিবুতে চিবুতে ঝিমাতে শুরু করেন। আব্বা-আম্মার দুইপক্ষীয় কথা হয় খুব কম। তারপরও তারা একে অপরের মনের ভাষা বুঝতে পারে। আম্মাকে ছাড়া আমার কৃষক বাবা আসলে অচল।
বুঝ হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি, আমাদের মা-বাবার এমনই এক জীবন যেখানে চাওয়া বা পাওয়ার কিছু থাকে না। তাই অনেক কিছু নাই এর গ্রামীণ সংসার ভালোবাসার প্রাচুর্যে ভরপুর। পারস্পরিক সৌহার্দ্যে টইটুম্বুর। অনেক না পাওয়ার আক্ষেপের মাঝেও আমাদের মনে আছে আনন্দ। পূর্ণতায় পরিপূর্ণ আমাদের নিটোল শৈশব। আমাদের দুরন্তপনার কাছে হার মেনেছে বাকিসব চাওয়া পাওয়া।
দিনে দিনে আমাদের বাড়িটার নাম হয়ে গেছে আনন্দপাড়া। বিকেল হলে পাড়ার ছেলেদের হাঁট বসে আমাদের বড় উঠোনে। মেয়েরা বউচি খেলে। আর ছেলের দল গোল্লাছুট, ক্রিকেট। গত পরশু, এই প্রথম আমরা ভাইবোনেরা মিলে আম্মার জন্মদিন পালন করলাম। আম্মা প্রথমে না না করল, তারপর কেক খেতে গিয়ে আনন্দাশ্রু জড়াল। পরদিন সবাই মিলে পিকনিক করলাম।
হাঁস ধর, জবাই কর, ভর্তা কর, মাছ রাধো, মসলা বাটোরে। ইলিশ কাটতে কাটতে, হইহই রইরই মাছের রাজা গেল কইরে। মা’র সে কি ব্যস্ততা। দেখে ভাবছিলাম-বোধহয় তার মেয়ের বিয়ে! গোলাপি শাড়িতে আম্মাকে এতো সুন্দর দেখায় আগে কখনো খেয়াল করিনি। আব্বা আম্মার হাত ধরে কেমন যেন রোগার মতো আনাড়ি হাসছিলেন। পাড়ার ছেলে-মেয়েরা চাওয়া-চাওয়ি আর আমাদের সাথে খোঁচাখুঁচি করছিল। আমি ভাবছিলাম, অনন্ত সুখের অবগাহনে দূরে কোথাও হারিয়ে যাওয়ার কথা। আহা! সুখ। মধ্যবিত্তের অভাব ও দুঃখ মিলেমিশে লাল-নীল, সোনালী সংসার।
ছয়.
দুই দিনের আনন্দযজ্ঞের পর বাড়ি এখন শান্ত। আমরা আবার একরকম আমাদের রুটিন জীবনে ফিরে এসেছি। এরই মাঝে আব্বা আম্মাকে শোনান অপার আনন্দের সংবাদ। আপার জন্য পাত্রের খোঁজ মিলেছে। ছেলে, আব্বার বন্ধু সলিম চাচার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। ডিগ্রি পাস করে ঢাকার কোনো এক কোম্পানিতে জব করছে। চাচা বলতে পারেনি। বাবার বিস্তর সম্পত্তি আছে। মেঘনা আরেকটু ভেঙে সামনে এগোলে নাকি বিশাল চরের মালিকও হবে। ছেলেদের কোনো দাবি-দাওয়া নেই। আমাদের বাড়ির সাথে তাদের বাড়ির সম্বন্ধ পাতাতে চায় কেবল। আব্বা হাসে আর দুটো শব্দ বলে—আমি আব্দুল হাদি সরকার। সরকারের মেয়ে বিয়ে করতে পারছে, আর কী চাই। আম্মা কিছু বলে না। আবার তার খুশি খুশি ভাবটা লুকাতেও পারে না।
আম্মা আপাকে ভালো করে গোসল করান। আপার পিঠে, নাকে, কানে জমে থাকা ময়লা ঘষে ঘষে তুলেন। আম্মার সাথে পড়শী বাড়ির মেয়েরাও যোগ দেয়। এরমধ্যে ছেলের সম্পর্কেও বেশ খোঁজ খবর নিয়েছেন আম্মা। ছেলে তার মনে ধরেছে। ফলে কোনো অঘটন না ঘটলে নিজের অষ্টাদশী কৃষ্ণকলি মেয়ের গতি হয়ে যাচ্ছে খুব সহজে।
দুইপক্ষ কথা শেষে আসছে শুক্রবার দেখার দিন ধার্য করে। ছেলে পক্ষে আট থেকে দশজন এসে আমাদের মসজিদে জুমা পড়বেন। তারপর খাওয়া দাওয়া শেষে কনে দেখা। দেখা শেষে মেলা করে আল্লাহ চাহেতু নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে আশা তাদের। সলিম চাচা বকবকায়—ছেলেপক্ষ আসবে বউ নিতে। তোমরা দিবা কিনা চিন্তা-ভাবনা কর। ছেলে বালা। বংশ একটু নিচা আর নয়া টাকা অইছে কথা সত্য। কিন্তু তোমাদের মেয়েতো ময়লা। ছেলে আবার উঁচা লম্বা, দেখতেও মাশাল্লা ভালো।
পুরো বাড়ি জুড়ে যেন ঈদের আনন্দ। এটা সেটা কেনাকাটা চলছে। আত্মীয়-স্বজন খোঁজ খবর নিচ্ছে। এ ক’দিনে আমি একটা ব্যাপার খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করছি-আমার নির্বাক আব্বাজান অযথা বেশি কথা বলছেন। এদিকে সেদিক তাকিয়ে লোক দেখানো হাসছেন। আর আম্মা যেন খানিকটা চুপ। আব্বা বেশ কয়েকবার আম্মাকে শুনিয়েছেন, আমি আহাদ আলী সরকার। আজগর আলী সরকারের একমাত্র পুত্র। আম্মা জবাবে কিছু বলেন না। আব্বা খুশি মনে মিনমিনে স্বরে এটা সেটা বলে যান। আমার আব্বাকে এভাবে দেখে বড় আনন্দ হয়। তাকে দেখে ভাবি, সারাজীবনে হেসে কথা বলার মতো কোনো উপলক্ষই হয়তো বাবা খুঁজে পায়নি! নইলে এমন মানুষ এতোগুলো বছর এভাবে চুপচাপ কি করে কাটাল?
খালাতো ভাই-বোনদের অনেকে চলে এসেছে। মামারাও হয়তো বিয়ের দিন আসবেন। দিনভর হইহইরইরই কাণ্ড। একদিকে বিয়ে বাড়ির ঝামেলা। আরেক দিকে আমাদের সামলানো। এ যেন ছোটদের বড় আনন্দ আজ/বড়দের তাই বেড়ে গেছে কাজ। দিনান্তে হই-হুল্লুর শেষে রাত নামলে শুরু হয় গল্পগুজুব। ভূতের গল্পের সময় পিচ্চিগুলো একেবারে চুপসে যায়। কখনো কখনো ভূত মানুষের বেশ ধরে টিনের ঘরের বেড়ায় টোকা দিয়ে যায়। মোটা স্বরে ঘেরঘের করে কথা বলে। তখন সব ভয়ে একসাথে গলাগলি করে ঢলে ঢলে পড়ে-হুহু, হাহা হাসে।
গল্প চলতে থাকে রাত অবধি। ততক্ষণে অনেকে ঘুমে। তারপর গাদাগাদি করে এক চকিতে জড়াজড়ি করে শোয়া। দেখতে দেখতে কত দ্রুত সময় কেটে যায়। রাত পোহালে শুক্রবার। গতরাতে পুরো বাড়ি সাজানো হয়েছে। ছেলেপক্ষ আসলে মেয়ে দেখতে আসবে না, বিয়ে করে নিয়ে যেতে আসবে। সবকিছু ঠিকঠাক-শুধু কবুল বলা বাকি। আপার সাথে কী কী দিয়ে দেওয়া হবে, কে কে যাবে এসব নিয়ে রাতভর বৎসা হয়েছে। নানা তর্ক-বিতর্কে, আনন্দ-আবেগে মৌ মৌ করা বাড়িতে ঝলমলে সকালকে স্বাগত জানিয়ে অন্ধকার রাতকে বিদায় বলতে বলতে রাত দু’টো। তারপর সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
সাত.
কিন্তু সেই অপেক্ষার সকাল! শুক্রবারের আলো ঝলমলে সকালটা দেখা দিল বড্ড মেঘ কালো হয়ে। বড় আপার খিঁচুনিটা আবার উঠেছে-এমনিতেই হাঁপানির রোগী। অনেক চেষ্টার পরও জ্ঞান ফেরানো যায়নি। অ্যাম্বুলেন্স আনতে ছোটাছুটি করছে কয়েকজন। খালারা মিলে মাথায় পানি ঢালছে। খালাতো ভাই-বোনরা এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। ছোট বোনটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার পিঠাপিঠি মারদাঙ্গা ভাইটা সকাল থেকে উধাও। মা-ভাই-বোন এসবের কিছুই আমার ভাবনায় নেই।
আমি আব্বার মুখের দিকে তাকাতে গিয়েও বারবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছি। আব্বার মুখে চোখ গেলে যেন দুনিয়ার সব দুঃখ ভুলে যাই। আমার আব্বা আগের চিরচেনা রূপে ঘরের দরজার সিঁড়িতে চুপচাপ বসে। দেহখানি নিশ্চল ও নীরব। আম্মা সেই দিনের গোলাপি শাড়িটা পরে পাক ঘরের সামনে। তাকে গোসল দেওয়া হচ্ছে। তারপর খাটিয়ায় করে গোরস্থানে রেখে আসা হবে। আব্বার চোখে পানি নেই, মুখে কোনো কথাও নেই। তবু বুঝতে অসুবিধা হয় না, সিঁড়ি থেকে কাঁত হয়ে থাকা তার শরীরের ছায়াটাও যেন গগনবিদারী আহাজারি করছে। সেই ছায়ার বিলাপে আকাশটা গুমোট ভারী হয়ে আছে। গাছ ও পাখিরা দলবেঁধে কান্নার কোরাস ধরেছে।
বিরতি দিয়ে দিয়ে ইমাম সাবের দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠ ইথারে ভাসছে-প্রিয় এলাকাবাসী, একটি শোক সংবাদ। একটি শোক সংবাদ...