এডিকশন দ্য লাস্ট পেইজ
বইয়ের পাতায় এক অদ্ভুত নেশা আছে বটে। নাহলে কি শাহরিকা বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকে সবসময়! এদিকে খাওয়া নেই, সময়মতো নাওয়া নেই। কখন যে সকাল হয়, আর কখন সন্ধ্যা সে খোঁজ রাখে না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি রোদ উঠেছে সেটা শাহরিকা বলতেই পারবে না।
অবশ্য বলতে না পারাটাই স্বাভাবিক। কারণ তার সকল ধ্যানজ্ঞান তো বই পড়ার মাঝে সীমাবদ্ধ। বই পড়লে নাকি তার জানার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে, এ আশায় দিন-রাত এক করে পড়াশোনা। তার রুমে যে একগাদা বইয়ের স্তূপ রয়েছে তাতে কি নেই? কবিতা থেকে উপন্যাস, সায়েন্সফিকশন থেকে হরর, ডিটেকটিভ থেকে অ্যাকশন- এ যেন ছোটো-খাটো গ্রন্থাগার। বই পড়ার যেমন নেশা, বই সংগ্রহ করাটাও শাহরিকার এক বিশাল নেশা।
একটি সায়েন্স ফিকশন পড়তে পড়তে সবেমাত্র ঘুমিয়েছিল শাহরিকা। হঠাৎই বান্ধবী জেরিনের ফোন বেজে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে ফোন ধরলো শাহরিকা। কারণ জেরিন তার সেইসব বান্ধবীদের মধ্যে একজন যাদের মাথায় সবসময় বইয়ের পোকা নড়াচড়া করে।
শাহরিকা : হ্যালো, হ্যাঁ, বল। কেমন আছিস? চারদিন ধরে তো কোনো খবর নেই?
জেরিন : আছি মোটামুটি, একটু ব্যস্ত সময় পার করেছি। এই প্লিজ কিছু মনে করিস না রে। তবে তোর জন্য একটা সুখবর আছে! শুনবি?
শাহরিকা : চারদিন পরে কি এমন সুখবর আনলি শুনি?
জেরিন : আর বলিস না, আম্মু বললো পরীক্ষা শেষ করে বাসায় না থেকে কোথাও থেকে ঘুরে আয়। তোর বাবারও তো টানা চারদিনের ছুটি। মাইন্ড ফ্রেশ হবে, পড়াশোনায় মনোযোগ আসবে। তাই আব্বু আমাকে নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো তার বন্ধুর বাসায়। হঠাৎ করে এই আয়োজন তাই তোকে বলার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
শাহরিকা : সবই তো বুঝলাম কিন্তু এখানে আমার জন্য সুখবর কি আছে শুধু সেটাই বুঝলাম না!
জেরিন : আগে কথা শেষ করতে দে...
শাহরিকা : আচ্ছা, আচ্ছা তারপর?
জেরিন : তারপর চট্টগ্রামে গেলাম। আব্বুর বন্ধু এক আজব মানুষ। তার বাসা দেখলে মনে হবে যেন প্রাচীন কালের কোনো এক যুগে চলে এসেছি। হরেক রকম কালেকশন, সে কি বাহারি কারুকাজ। ভাষায় প্রকাশ করলেও কম হবে।
শাহরিকা : নিশ্চয় পুরোনো বইও ছিল?
জেরিন : আরে, সেটা আবার বলতে! তিনি নাকি পঁচিশ বছর বয়স থেকে পুরাতন আমলের জিনিসপত্র সংগ্রহ করা শুরু করেছেন। আমার তো নজর ছিল বইয়ের দিকে।
শাহরিকা : তারপর?
জেরিন : বইগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং! কোনটার পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গেছে আবার কোনোটা আগুনে আংশিক পুড়ে গেছে। বিচিত্র সেগুলোর নাম আর ভাষা। কয়েকটা বই তো ভৌতিক লেগেছে।
শাহরিকা : তুই পড়িস নি?
জেরিন : পড়েছি তো। আমি বেছে বেছে সায়েন্স ফিকশন বইগুলো পড়েছি। দারুণ সব বই।
শাহরিকা : সাথে করে আনলি না কেনো?
জেরিন : আরে তাই আবার হয় নাকি? বইগুলো কোনোটাই এখনকার সময়ের আধুনিক ধাঁচের নয়। এগুলো তো অনেক কষ্টে আঙ্কেল সংগ্রহ করেছেন। তবে পরীক্ষা দিয়ে তোদের সাথে নিয়ে আবার যাবো ভাবছি।
শাহরিকা : ইয়াহু! তাহলে তো দারুণ ব্যাপার। এটাই তোর সুখবর?
জেরিন : হ্যাঁ, কেনো? তুই খুশি না?
শাহরিকা : খুশি না মনে! খুব খুশি, ইয়াহু!
জেরিন : শোন, তাহলে কথা কিন্তু ওটাই থাকলো। সামনের মাসে পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই আমরা বান্ধবীরা মিলে চট্টগ্রাম যাচ্ছি।
শাহরিকা : আমি রাজি। আর কে কে থাকবে সাথে?
জেরিন : আমি, তুই, নওশীন, ইশিতা আর জেসমিন।
শাহরিকা : ওহহ, আচ্ছা আচ্ছা বেশ।
জেরিন : শোন, আমি বাকিদের ফোন করে কথাটা জানিয়ে রাখছি। পরীক্ষার তো আর মাত্র এক মাস বাকি আছে। তারপর লম্বা ছুটি। আমি তো কমপক্ষে বিশ-বাইশদিন থাকার নিয়ত করেছি। তোর কি মত?
শাহরিকা : পরীক্ষার পরে তো আমাদের তেমন কোনো কাজ নেই। আর যদি ঘুরে মজা পাওয়া যায় তাহলে দীর্ঘ সময় থাকাই যায়। আমার কোনো আপত্তি নেই।
জেরিন : ঠিক আছে, আমি ফোন রাখছি। আর বাকিদের জানিয়ে দিচ্ছি। তোর সাথে পরে কথা বলবো।
শাহরিকা : আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো থাক।
জেরিন : ওকে।
শাহরিকা মনে মনে বেশ খুশি হলো। এমনিতেও তার ঘোরাঘুরি করার সুযোগ মেলে না। তারপর যদি চট্টগ্রাম যাওয়া যায় এই সুযোগ হাতছাড়া করবে কি করে! মনটা যেন খুশিতে নেচে উঠছে বারবার। বই পড়া তার কাছে জীবনের প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। আর সেগুলো ঐতিহাসিক হয় তাহলে তো কথাই নেই, জমে যাবে। এদিকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
এটা তো আর ফ্যামিলি বাসা নয় যে ইচ্ছামতো শুয়ে থাকলেই হয়। অনেক কাজ রয়েছে শাহরিকার। হোস্টেলে থাকে সে, যদিও সাবলেট একটি সিঙ্গেল রুম। তবুও নিজের কাজগুলো তো নিজেকেই করতে হবে। রুম পরিষ্কার করা, রান্না করা, পড়াশোনা। ওহহ কত্ত কাজ বাকি, নিজের ওপরই নিজে বিরক্ত হয়ে ওঠে শাহরিকা। সামনের মাসে পরীক্ষা আছে, অথচ অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার কোনো নামগন্ধ নেই।
দেখতে দেখতে রাত নেমে এলো। আলো-আঁধারির শহরে সময় খুব দ্রুত কেটে যায়। চোখের পলকে দিন থেকে রাত আবার দিন। সময় ফুরিয়ে যায় কিন্তু কাজ ঠিক সময়ে শেষ করা যায় না। শাহরিকার মাথায় শুধু জেরিনের কথাগুলো ঘুরছে। তার আজকে পড়াশোনায় আর মন বসবে না। মনের ভেতর যেন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে।
পরীক্ষা কবে শেষ হবে? চট্টগ্রাম সে কবে যাবে? প্রশ্নের উত্তর মিলবে এক মাস পরে। এই এক মাস তার কাছে এক বছরের সমান মনে হচ্ছে। না, বেশি ভেবে কাজ নেই, তার চেয়ে একটা সায়েন্স ফিকশন বই পড়ে মনটাকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করা উচিত বলে শাহরিকার মনে হলো।
যে ভাবা সেই কাজ। কিন্তু পড়তে পড়তে রাত এগারোটা বেজে গেলো, তার একবারও ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকানোর খেয়াল আসেনি। একসময় নিস্তব্ধতা চারপাশ ঘিরে ধরে, কোলাহল শহরটা যেন ধীরে ধীরে চুপ হতে থাকে। রাত দুটো বেজে গেছে, শাহরিকার চোখ ঘুমে ছেয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে, হাতে বই নিয়ে একসময় ঘুমে ঢলে পড়ে সে।
চলবে.........