বাড়ছে অগ্নিকাণ্ড, দগ্ধ হচ্ছে নারী-শিশু
ঘটনা-১: লিপইয়ারকে স্মরণীয় করে রাখতে বেইলী রোডের রেস্তোরাঁয় পরিবার ও বন্ধুবান্ধবসমেত গিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু তাদের অনেককেই স্মরণীয় করে দিল এক অগ্নিদুর্ঘটনা। ২০২৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে সংঘটিত এ অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন ৪৬ জন। আহত অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঘটনা-২: গত ১৩ জানুয়ারি রান্নাঘরের আগুনে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের মহাজনপাড়ার একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন একজন। রাত ২টার দিকে উপজেলার পারুয়া ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড মহাজনপাড়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
শুধু এ দুটো ঘটনাই নয়। আমাদের অসাবধানতায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে এমন অগ্নিকাণ্ড। অকালে হারাতে হচ্ছে জীবন।
নিমতলী ট্র্যাজেডির কথা আজও দেশের মানুষ স্মরণ করে। ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিক পদার্থের গুদামে আগুনে প্রাণ হারায় ১২৪ জন। ছয়তলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় একটি আনন্দপূর্ণ বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন মুহূর্তে পরিণত হয় শোকের মাতমে। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সাভারের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডের একটি পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের কথাও মানুষ ভুলে যায়নি। এ দুর্ঘটনায় মারা যান ১১২ জন শ্রমিক।
অগ্নিকাণ্ডের এমন উদাহরণ অনেকই দেওয়া যাবে। সামান্য সচেতনতা ও পূর্বপ্রস্তুতি আমাদের এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতা থেকে দূরে রাখতে পারে।
মানুষের দৈনন্দিন কাজে আগুনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। ঘরের রান্না থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানায় আগুন একটি অপরিহার্য উপাদান। চলমান এই জীবনে আগুনের প্রয়োজন যেমনি আছে, তেমনি এই আগুনের ছোবলেই অকালে ঝরছে অনেক প্রাণ। সারাদেশে প্রতি মাসে, প্রতি সপ্তাহে এমনকি প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অগ্নিকাণ্ড জানমালের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। এর বেশির ভাগের জন্য দায়ী আমাদের অসাবধানতা, অসতর্কতা কিংবা অবহেলা।
নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশে কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান, গার্মেন্টসহ সুউচ্চ ভবনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্র ও সংখ্যা দুটোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সচেতনতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৮ হাজার ৪৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রায় ৪৩০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। সচেতন হলে এর মধ্যে অনেক দুর্ঘটনাই এড়ানো যেত।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটের সহকারী অধ্যাপক ডা. তানভীর আহমেদের মতে, গ্রীষ্মকালের চেয়ে শীতকালে অগ্নিদগ্ধ রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ শীতকালে আগুনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। আবার আবহাওয়াও থাকে অতিরিক্ত শুষ্ক। শীতকালে বারবার খাবার গরম করা, অজু ও গোসলের পানি গরম করা, রান্নাঘর থেকে গরম পানি গোসলখানায় নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে তাড়াহুড়া হয় বেশি। আর এতেই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। এ ছাড়া শীতকালে গ্রামীণ জনপদে আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহানোর রেওয়াজ লক্ষ করা যায়। এতে অগ্নিকাণ্ডের বিপত্তি বাড়ে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি ও বার্ন ইউনিটে প্রতিদিন বাড়ছে অগ্নিদগ্ধ রোগীর ভিড়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অগ্নিদগ্ধ রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। শুধু অসচেতনতার কারণেই বেশির ভাগ অগ্নিদগ্ধের ঘটনা ঘটে। ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে অগ্নিকাণ্ড ও এ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেতে পারে। গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, মসজিদ-মাদরাসা, স্কুল-কলেজে মাইকিং ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত প্রচার করতে হবে।
আগুনে প্রাণহানি ঠেকানো হচ্ছে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কারো শরীরে আগুন লাগলে পানি পাওয়া না গেলে মাটিতে শুয়ে কীভাবে গড়াগড়ি দিতে হবে তা সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে।
গ্রামে-গঞ্জে মাটির চুলা সমতল ভ‚মিতে করা হয়। রান্না শেষে মা সরে গেলে শিশু এসে খেলার ছলে চুলায় হাত দিয়ে অগ্নিদগ্ধ হয়। তাই মাটির চুলাকে উঁচুস্থানে করতে হবে, যাতে শিশু নাগাল না পায়। রান্নাঘরের চারপাশে বাউন্ডারি দেয়াল দিয়ে দরজা লাগাতে হবে, যাতে শিশু চুলার কাছে যেতে না পারে।
প্রায়ই দেখা যায় রান্নাঘরে অসাবধানতাবশত মহিলাদের কাপড়ে আগুন লেগে যায়। তাই রান্নাঘরে রান্নার সময় মহিলাদের শরীরে কাপড় সাবধানে রাখতে হবে, যাতে আগুনের কোনো স্পর্শ না লাগে। বিশেষ করে রান্নার সময় সিনথেটিক কাপড় ব্যবহার থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন, কারণ এতে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চুলা থেকে পাতিল নামানোর সময় শাড়ির আঁচল বা ওড়না ব্যবহার না করে ভিন্ন মোটা কাপড় ব্যবহার করা নিরাপদ।
আমাদের দেশে শীতকালে ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে আগুনের তাপ নেন। নিরাপদ দূরত্বে থেকে সাবধানে আগুন পোহাতে হবে এবং প্রয়োজন শেষে ভালোভাবে আগুন নেভাতে হবে, যাতে পরবর্তীতে ছড়াতে না পারে। রাতের বেলা ঘরে মোমবাতি বা মশার কয়েল ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। মোমবাতি বা মশার কয়েল এমন দূরত্বে রাখতে হবে যাতে অনেক বাতাসেও তা বিছানা বা কোনো কিছুর সংস্পর্শে আসতে না পারে।
বৈদ্যুতিক গোলযোগ অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই দক্ষ বিদ্যুৎকর্মী দিয়ে বিদ্যুতের তারের লোড যথাযথভাবে পরীক্ষা করে কানেকশন দিতে হবে। লোডের অতিরিক্ত কানেকশন দেওয়া যাবে না। এতে করে তার গরম হয়ে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। সব ধরনের বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ থেকে বিরত থাকতে হবে। গ্যাসলাইন থেকেও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। তাই নিরাপদ গ্যাস সংযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও পোশাক কারখানাতে আগুন নিভানোর জন্য বালি ও পানির উৎসসহ ন্যূনতম ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট থাকতে হবে। বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুুতি হিসাবে সবার জন্য বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য আগুন প্রতিরোধের ধারণামূলক প্রশিক্ষণ কর্মশালা এবং মহড়ার আয়োজন করতে হবে। আগুন লাগার সাথে সাথে দ্রুত কারখানা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সব পথ খোলা রাখার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
দেশে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধ করতে কাজ করে যাচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বাহিনী। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে তারা ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকার এ বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে ৩৩০টি ফায়ার স্টেশন রয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে আরও ২৪৪টি ফায়ার স্টেশন স্থাপন করার কাজ চলছে। পাশাপাশি শিল্পকারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন স্থাপনায় নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণবিষয়ক মহড়া আয়োজন করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোতেও অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসাসেবার মান যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। দেশে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসার জন্য বার্ন ইউনিট রয়েছে। এ ছাড়াও প্রতিটি জেলার সরকারি হাসপাতালে অগ্নিদগ্ধ রোগীর চিকিৎসায় বিশেষ ব্যবস্থা বিদ্যমান।
আমরা আর কোনো বেইলী রোড, নিমতলী বা তাজরীন ট্র্যাজেডির মুখোমুখি হতে চাই না। সাবধানে ও যথাযথ নিয়ম মেনে চললে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা অনেক কমে আসবে। উল্লিখিত বিষয়গুলো সচেতনভাবে পালন করে আমরা নিজেরা ভালো থাকতে পারি। বাঁচাতে পারি নিজেদের জীবন ও মূল্যবান সম্পদ। পিআইবি ফিচার