ব্রেকআপের কষ্ট কি উপকারিও হতে পারে?
একটা সত্যিকার প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সারা জীবন একসাথে চলার স্বপ্ন নিয়ে যে পথচলা শুরু তা যখন মাঝপথেই বাধার মুখে পড়ে, সেই কষ্ট মেনে নিতে পারেন না অনেকে।
তবে এই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া বা ব্রেকআপ কি কখনও কারও জন্য ভালো ফলও বয়ে আনে না?
আপনি হয়তো ভাবছেন এটা কী ধরনের প্রশ্ন? সম্পর্ক ভেঙে গেলে কেউ কি খুশি হয়? এমনকি আপনি হয়তো এর উপকারিতার কথা ভাবতেও পারছেন না।
‘দ্য ব্রেকআপ মোনোলগস’ বইয়ের লেখক রোজি উইলবি মনে করেন, সম্পর্ক ভাঙার অনেক উপকারিতা রয়েছে।
রোজি উইলবি এর আগে একই নামে তার পডকাস্ট উপস্থাপন করেছিলেন। পরে তিনি একই নামে একটি বই লেখেন।
এই বইয়ে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন। এ ছাড়া পডকাস্টে অতিথিদের সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি মানবিক সম্পর্ক সম্পর্কে যা বুঝেছিলেন, তা নিজের বইয়ে স্থান দিয়েছেন।
বইটি লেখার জন্য তিনি অনেক চিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছেন।
বিবিসি রিলস-এ রোজি উইলবি বলেন, সম্পর্কের কারণে মন ভেঙে যাওয়ার ঘটনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। ব্রেকআপ অবশ্যই কখনোই ভালো বলে বিবেচিত হয় না, কিন্তু এটাও সম্ভব যে এটা আপনার জন্য ভালো হতে পারে।
নিজেকে বোঝার সুযোগ
রোজি উইলবির মতে, কোন ধরনের ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক হওয়া উচিত বা কোন ধরনের ব্যক্তির সাথে আমাদের সম্পর্ক থাকা উচিত সে সম্পর্কে পুনর্বিবেচনা এবং চিন্তা করার সুযোগ দেয় ব্রেকআপগুলো এবং কখনও কখনও হৃদয় ভাঙার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা নিজের সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাই এবং আমরা আরও ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হই।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. সমীর মালহোত্রাও বিশ্বাস করেন যে কখনও কখনও কোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া আপনার চোখ খুলে দেয়।
ড. মালহোত্রা বলেন, মাঝে মাঝে ব্রেকআপ আপনাকে নিজেকে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়। ব্রেকআপকে আপনি কীভাবে দেখেন তা আপনার ওপর নির্ভর করে। আপনি যদি অন্যের ভুল খুঁজতে থাকেন তবে আপনি কখনই নিজেকে উন্নত করার চেষ্টা করতে পারবেন না।
প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা আলাদা
দিল্লির মনোবিজ্ঞানী শিবানী মিশ্রি সাধু বলছেন, ব্রেকআপ সবার জন্যই কঠিন এবং তা কাটিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা সবারই আলাদা। তবে মাঝে মাঝে সম্পর্ক ছিন্ন করাও আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।
‘আপনি যখন ব্রেকআপ করেন, তখন আপনি নিজের সম্পর্কে শেখার এবং নিজেকে উন্নত করার সুযোগ পান।’
মাদকাসক্তির সাথে তুলনা
রোজি উইলবি ব্রেকআপকে মাদকাসক্তির সাথে তুলনা করেছেন। তার মতে, মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে মাদক সেবন থেকে বিরত রাখা হলে তার আচরণ যেমন হয়, সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ব্যক্তির আচরণও একই রকম হয়।
ড. সমীর মালহোত্রা বলছেন, যখন প্রেমের হরমোন অর্থাৎ অক্সিটোসিন মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে বৃদ্ধি পায়, তখন অন্য ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। এটা সব ধরনের ভালোবাসাতেই দেখা যায়। এ কারণে কোনো একজনের সাথে আপনার দেখা করার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যায়, কিন্তু যদি তার সাথে দেখা না হয় বা সম্পর্ক ভেঙে যায়, তাহলে আমাদের অবস্থা মাদকাসক্তের মতো হয়ে যায়, যে মাদক পাচ্ছে না।
নতুন সম্পর্ক শুরুর আগে...
রোজি উইলবি বলেন, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। এটি একটি কঠিন কাজ কারণ সম্পর্কগুলো আপনার জীবনে প্রচুর ঝামেলা তৈরি করে। আপনাকে অন্য ব্যক্তির দিকে এবং তার ভালো এবং মন্দ উভয়ের দিকেই নজর দিতে হবে।
‘ব্রেকআপের পর অন্য কোনো সম্পর্কে ফিরে আসার আগে সময় নিন এবং নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন।’
তবে এর অর্থ এই নয় যে আপনি সন্ন্যাসী হয়ে উঠবেন এবং যৌনতা থেকে পুরোপুরি দূরে থাকবেন।
নিজের সাথে সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ
ড. সমীর মালহোত্রাও রোজি উইলবির পয়েন্টকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বলেন, অনেক সময় মানুষের মনে হয়, একটি সম্পর্ক ভেঙে গেলে খুব শিগগিরই আরেকটি সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত। এটা ভুল। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমাদের নিজেদের সঙ্গে। কিছু নীতি, কিছু ভারসাম্য, কিছু শৃঙ্খলা থাকতে হবে।
ডা. মালহোত্রার মতে, আপনার শক্তি কিছু সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করা উচিত। আমাদের উচিত নিজের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা করা এবং কারো ত্রুটি-বিচ্যুতি বুঝে তা দূর করার চেষ্টা করা।
তিনি বলেন, যখনই আমরা কোনো সম্পর্কের কথা বলি, সেখানে দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একটি হলো অঙ্গীকার এবং অন্যটি দূরত্ব। সহজ ভাষায় বলা হলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে ঘনিষ্ঠতার পাশাপাশি দূরত্বও খুবই জরুরি।
চিন্তার পরিবর্তন হচ্ছে
শিবানী মিশ্রি সাধু মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়াতেও ব্রেকআপ নিয়ে মানুষের মতামত বদলাতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন মানুষ বুঝতে শুরু করেছে যে বিষাক্ত সম্পর্কের মধ্যে থাকা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে শুরু করে, কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি এখনও এমন যে তা থেকে বেরিয়ে আসা কিছুটা কঠিন।
ব্রেকআপের পর পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে পূজা শিবম জেটলি নামে এক নারী বলেন, আপনি বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করতে পারেন, নতুন কোনো কাজ শুরু করতে পারেন, নতুন করে জীবন যাপন করতে শিখতে পারেন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনি নিজের গুরুত্ব বুঝতে শুরু করতে পারেন।
শিবানী মিশ্রি সাধু বলেন, ব্রেকআপের পরও আপনি সুখি হতে পারেন।
এনএফ