বাবা সেদিনে চোখ খোলেনি
বাবার কথা আজ খুব মনে পড়ছে। বাবা মারা যাবার পর সেদিন আমি কাঁদতে পারিনি। যেই আমি অল্পতেই বোকার মতো কেঁদে ফেলি, সেদিন একটুও কাঁদিনি। বড় বোন, চাচা-মামাদেরকেও আমি কাঁদতে মানা করছি। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলছি- বাবা চলে গেছেন তো কী হয়েছে! আমি তো আছি। তোমরা একদম ভেবো না। এখন থেকে পরিবারের সবকিছুই আমার দায়িত্বে। একদম ভেবোনা তোমরা! আমি অনেক বড় হয়েছি। এই দেখো, বাবাকে শেষ বিদায় দিতে পানি গনম করছি, বাজার থেকে বাবার জন্যে সাদা ঝকঝকে কাপড় নিয়ে এসেছি; সঙ্গে গোলাপ জল, আগর বাতি, কর্পুরও এনেছি। আমি নিজ হাতে বাবাকে আজ জামা পরিয়ে দেবো।
সেই ছোটবেলায় বাবা আমাকে মক্তবে নিয়ে যেতেন, সাইকেলের প্যাডেল চালানো থেকে শুরু করে সাঁতার কাটা সবকিছুই আমাকে শিখিয়েছেন বাবা-ই। আমাকে কত সুন্দর করে জামা পরাতেন, এমনকি বড় হবার পরও বাবা আমাকে ছোট শিশুর মত নতুন জামা পরিয়ে দিতেন সবার সামনে। আমি খুব লজ্জা পেতাম। এই আমি আজ বাবাকে সাদা কাপড় পরিয়ে নিজ হাতেই দাফন করে আসবো। এই দেখো মা! আমি বাবাকে কতবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছি, অথচ আমি ভয় পাচ্ছি না। আমি আজ মৃত মানুষ দেখে ভয় পাচ্ছি না মা। কারণ, আমি নিজেকে সান্তনা দিচ্ছি, বাবা মারা যাননি। ছোট বোনটি আমাকে বলছে- সত্যিই বাবা নেই রে! বললাম, তোমরা সবাই বোকার মতো শুধু বলছো- বাবা নেই। দেখবে- বাবা হঠাৎ চোখ খুলবে। চোখ খুলেই দেখবে- তার ছোট্ট ছেলেটি স্থির বসে আছে মেঝেতে শুয়ে থাকা বাবার শিয়রে। তখন বাবা আমার মাথায় হাত রাখবে- আমি চিৎকার করে বলবো- মা! ও মা! মাগো! দেখো আমার বাবা চোখ খুলেছে। তখন তোমরা চোখের পানি মুছে ফেলবে এবং আমি হাসবো।
চাচা-মামারা সবাই এসছেন বাবাকে দেখার জন্যে, আপুরা কাঁদছেন। আমি একটুও কাঁদছি না। মনে মনে ভাবছি, হঠাৎ বাবা চোখ খুলবেন। তখন সবাই কিছুক্ষণ থেকে আবার চলে যাবেন। পেপার- পত্রিকায় কত দেখেছি- গোসল দেওয়ার সময় মৃত মানুষ জেগে উঠেছে। দাফনের অল্প আগেই মৃত শিশু কেঁদে উঠেছে। ঠিক এভাবেই আমার বাবা জেগে উঠবেন, চোখ খুলবেন। অনেক সময় গড়ালো, কিন্তু বাবা চোখ খোলেননি। এতক্ষণে আমাদের বাড়িটা লোকারণ্য হয়ে উঠেছে। আমার বাবার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাঁদতে কাঁদতে বাবার ঘরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ কেঁদে পরে বেরিয়ে এলেন। আশ্চর্য! তিনিও বিশ্বাস করে ফেলেছেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি আর নেই। বন্ধুর সঙ্গে শেষবারের মতো সাক্ষাৎ শেষে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এলেন। আহা! সব বন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ বুঝি এমনই হয়। মামারা আমাকে সান্তনা দিচ্ছেন। অথচ, সেদিকে আমার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। উল্টো আমি তাদের বলছি- দেখো, আমার বাবা ঠিকই চোখ খুলবেন, অপেক্ষা করো। তারা বললেন- ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে। কথায় আছে না- ‘অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর’। ছেলেটা এই বয়সে বাবা হারিয়েছে তো! তার দুঃখটা বোঝার চেষ্টা করো। কেউ তাকে কিছু বলো না যেন। আমি তাকিয়ে আছি বাবার শুভ্র দাড়ির সদাহাস্য মুখটির দিকে। আমার মনের বাসনা- বাবা একসময় চোখে খুলবেন। নিশ্চয়ই খুলবেন।
এলাকার ক’জন লোক মসজিদ থেকে খাটিয়া নিয়ে আঙিনায় হাজির। তারা কবর খননের জায়গাটা দেখিয়ে দিতে বললো। ছোট মামাকে নিয়ে বাড়ির পেছনের ভিটার একটা জায়গা দেখিয়ে দিলাম। আশপাশের সবগুলো মসজিদের মাইকে শোক সংবাদ ঘোষণা করা হচ্ছে, একটার পর একটা আমার কানে শুধু বাজছে আর আমি কাঁপছি। কাঁপা গলায় বাবার সবচেয়ে প্রিয় একজন আলেমকে ফোনে সংবাদ জানালাম। সবাই চলে এসেছেন। আমাকে সান্তনা দিতে ও সহযোগিতা করতে আমার সহপাঠীরা চলে এসেছে অনেক আগেই। আশ্চর্য ! তাদের জড়িয়ে ধরেও আমি কাঁদছি না। তারা কী ভাবছে কে জানে! বাবাকে কাফন পরানো থেকে নিয়ে বাকি কাজ তারাই সম্পাদন করেছেন। ঘর থেকে বের করার আগে সবার শেষে মা গেলেন বাবার কাছে, সঙ্গে শুধু আমি ছিলাম। বাবার হাতে হাত রেখে মা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং নিচু কণ্ঠে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলেন। শেষবার আমি বাবার বুকে কান পেতে শ্বাস-প্রশ্বাস আছে কি না দেখে নিলাম, যেহেতু বাবা চোখ খুলছেন না।
যেহেতু বাবা চোখ খুলছেন না; যেহেতু বাবার শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ- সবাই মিলে তাঁকে খাটিয়ায় তুললাম। জানাযা অনুষ্ঠিত হবে জামে মসজিদের মাঠে। এসেছেন এলাকার সবচেয়ে বড় আলেম। সহস্র মানুষের সামনে আমাকে পরিচয় করানো হচ্ছে- মরহুমের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র আবু সুফিয়ান তার নাম। সোবহান পরিবারের সঙ্গে যে কোনো প্রয়োজনে এখন থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। এতিম ছেলেটির প্রতি সবাই সমবেদনা জানালেন। সবার উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলতে আদেশ দিয়ে মাইক হাতে দিলেন কাকা। কী বলেছি এখন আর মনে নেই। হয়তো বলেছি, সবাই আমার বাবাকে ক্ষমা করে দেবেন। আর বলেছি- কারো কোনো ঋণ থাকলে...। এসব ভাবতেই আজ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অথচ, সেদিন আমি জানাযা শেষে বাবাকে কাঁধে করে রেখে এসেছি মাটির নিচে, নিজ হাতে। তখনও আমি একটুও কাঁদিনি, বাবা চোখ খুলবেন বলে। আবার জেগে উঠবেন বলে।
অথচ, বাবা তখনও চোখ খোলেননি। এমনকী আমি যখন বাবার মাথাটা শেষবারের মতো কেবলামুখী করে দিচ্ছি তখনও। যখন আমি কোমল হাতে বাবার কবরে মাটি ঢেলে বাবাকে সবার কাছ থেকে অদৃশ্য করে ফেলছি, তখনও। বাবা! আমি আজ খুব কাঁদবো, তোমার শোকে নয়; সেদিন তুমি চোখ খোলোনি বলে! আমাকে মন ভরে কাঁদতে দাওনি বলে।
বাবা নেই ছয় বছর হতে চলল, গতরাতে মায়ের মুখে শুনলাম বাবার জীবনের শেষ দিনগুলোর আবেগঘন, শ্বাসরুদ্ধকর স্মৃতিচারণ। হাসপাতালে বিড়ম্বনা, আই.সি.ইউতে লাশ রেখে ব্যবসা এবং আমার ব্যাপারে একান্তে মাকে বলা বাবার স্বপ্নগুলো। বাবা একটা কথা সবসময় বলতেন- আমার জীবনে অনেকগুলো কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি ; শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সেই সীদ্ধান্তে অটল থাকবো সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আমার সিদ্ধান্ত ও কর্মকৌশল গোপন রাখা। বাবা চাইতেন- আমি যেন তার সুপুত্র হই, সুপুত্রের ব্যাখ্যাও তিনি আমাকে বলেছিলেন। জানিনা, বাবার স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবো কি না। বাবার সুপুত্র হতে পেরছি কি না। আল্লাহ তায়ালা বাবাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।