বাবা আমার শর্তহীন ব্যাংক
শ্রদ্ধেয় বাবা,
তোমাকে নিয়ে কখনো কিছু লেখা হয়নি। তোমাকে কতটা ভালোবাসি, তাও কোনদিন মুখ ফুটে বলা হয়নি। কী এক লজ্জায় গুলিয়ে ফেলি সবসময়! তাই আজকেও তোমাকে নিয়ে কিছু লিখতে গিয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলছি। আমি আজ নিজে বাবা হয়ে বুঝতে পারছি, তোমার প্রতি ভালোবাসা মুখে না বললেও তুমি ঠিকই বুঝতে পারো।
আজ খুব মনে পড়ছে সেই ছোটবেলার কথা। তোমার শার্টের বুক পকেট ছিল আমার জন্য শর্তহীন ব্যাংক। যখনই কোনো দরকার হতো, তোমার পকেট থেকে টাকা নিয়ে খরচ করতাম। খরচ শেষে শুধু হিসাবটা দিলেই হতো। ভাবতেই আশ্চর্য লাগে, তুমি কীভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন কাজ করে আবার পরদিন মধ্যরাত থেকেই কাজে লেগে যেতে! আমাদের ঘুম নষ্ট হবে বলে তুমি ডাকতে না! নিজের সুখের চিন্তা না করে শুধু সংসার নিয়েই ভাবনা ছিল তোমার সারাক্ষণ।
বাবা, তুমি আসলেই শ্রেষ্ঠ কৃষক। জমিতে ফসল বোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জমিনে সততা, নিষ্ঠা, মানবতার যে বীজ বপন করেছ তা বিফলে যেতে দেইনি বাবা। কলেজে ভর্তির পরে ছাত্রাবাসে চলে যাওয়ার দিন ভাত খেতে খেতে তুমি বলেছিলে, ‘আজ থেকে বাড়ির বাইরে চলে যাচ্ছো। একা একা অনেক স্বাধীনতা ভোগ করবে। তবে যাই করো না কেন, এমন কোন কাজ করো না, যাতে তোমার জন্যে কখনও আমার মাথা নত হয়ে যায়।’ তোমার সেই ছোট্ট একটা কথা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ছোট্ট সেই কথার ভার সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ ঠিকই বুঝতে পারছি কতটা বিচক্ষণতার সঙ্গে কথাগুলো বলেছিলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ঢাবি, জাবি’তে অপেক্ষমান তালিকা থেকে চান্স না পাওয়ায় আমার মন খারাপ দেখে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলে, ‘যেখানেই পড়ো না কেন, সেটাকে কখনো ছোট করে দেখো না। মনোযোগ সহকারে পড়লে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা পাশ করবে তুমিও তাদের সঙ্গেই চাকরি করতে পারবে।’ বাবা, তোমার কথাই আজ সত্যি হয়েছে। বাবা, তুমি যেভাবে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে জলাঞ্জলি দিয়ে একদম নাজুক পরিস্থিতি থেকে সংসারটাকে সুদৃঢ় অবস্থানে নিয়ে এসেছো, মনে হয় না আমি তোমার চার ভাগের এক ভাগও সফল হতে পারব।
গত বছর হঠাৎ করেই তুমি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে। তোমার জীবন সংকটে তাড়াহুড়া করে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার বললেন, রক্তশূন্যতা। দ্রুত তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হবে। রক্ত জোগাড় করার জন্য আমাদের তিন ভাইয়ের অস্থিরতা দেখে আমার হাত ধরে হিমালয়সম সাহস নিয়ে বলেছিলে, ‘আমাকে নিয়ে এত পেরেশান হয়োনা, যতদিন হায়াত আছে ততদিন বাঁচব।’ সেদিনও তোমার মুমূর্ষু অবস্থার চেয়ে আমাদের পেরেশানিকেই বড় করে দেখেছ। রাতে সবাই বাড়ি চলে গেলে তোমার সঙ্গে হাসপাতালে আমি একা রয়ে গেলাম। হাসপাতালের খাবার খেতে পারবে না ভেবে সন্ধ্যায় বাইরের দোকান থেকে দু’টি স্পেশাল নান আর সবজি নিয়ে এলাম। গরম নান দু‘টি খেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, নানের দোকানটা হাসপাতাল থেকে অনেক দূরে কি না? আমি আবার যেতে চাইলেও তুমি বাধা দিলে। তখন নিজেকে একজন ব্যর্থ সন্তান মনে হচ্ছিল। সেদিন তোমার কিছু হয়ে গেলে এই নান নিয়ে আক্ষেপটা সারাজীবন ভোগাত।
তোমার হাড্ডিসার শরীরে রক্ত পুশ করতে ক্যানোলা রেডি করতেই প্রায় পাঁচ মিনিট লাগল। খেয়াল করলাম সংসারের চাপে তুমি নিজের শরীরের প্রতি কতটা অবহেলা, অবিচার করেছ! রক্তের ফোঁটা যখন তোমার শরীরে ঢুকছিল তখন তুমি বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছিলে। হাত, পা নড়াচড়া করছিলে। এপাশ ওপাশ কাত হয়ে যাচ্ছিলে। হয়ত তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল। আমি পাগলের মতো তোমার হাত, পা টিপে দিচ্ছিলাম যাতে একটু আরামবোধ হয়। সেদিন তোমার শরীরের করুণ অবস্থা দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। ছয় ঘণ্টা পর রাত ২ টার দিকে এক ব্যাগ রক্ত দেওয়ার শেষ হয়। তুমি অবুঝ শিশুর মতো ঘুমিয়ে গেলে। মনে হচ্ছিল তুমি অনেক দিনের বাকি ঘুমের দেনা মিটাচ্ছো। তুমি ঘুমালেও সে রাতে তোমার চিন্তায় আমি ঘুমাতে পারিনি। তোমার শরীরের প্রতি অবিচার দেখে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না।
আল্লাহর রহমতে একটু সুস্থ হলেই উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে এলাম। নানা রকম টেস্ট করে ওষুধে দিয়ে ডাক্তার তোমার প্রিয় প্রিয় খাবারগুলো নিষেধ করে দিলেন। তুমি ফ্যালফ্যাল করে অবুঝ শিশুর মতো সবার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলে, ‘তাহলে আমি কী খেয়ে বাঁচব?’ জানো বাবা, ইলিশ খাওয়া তোমার নিষেধ বলে এখন আর আগের মতো আনন্দ নিয়ে ইলিশ খেতে পারি না। ইলিশ মাছ খেতে গেলেই তোমার কথা মনে পড়ে।
যাই হোক আল্লাহর অশেষ রহমতে তুমি এখনও আমাদের মাঝে বটবৃক্ষের ছায়া হয়ে বেঁচে আছো বলেই অনেকটা ভারমুক্ত সময় কাটাতে পারছি। জানি না, কথাগুলো তোমার কাছে পৌঁছাবে কি না। বিধির কৃপায় তোমার কাছে পৌঁছালে জেনে নিও বাবা, ‘আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি। আরো অনেকদিন তোমার পরম স্নেহের ছায়ায় নিজেকে ভারমুক্ত রাখতে চাই।’