আমার ফাঁকিবাজ বাবা
প্রতি বছর রোজা শুরু হলেই পুরো রমযান মাস বাবা আমাকে এড়িয়ে চলতেন। যেন দর্জির দোকানে নিয়ে তার জন্য ইদের পায়জামা-পাঞ্জাবির মাপ দিতে না পারি! পাছে আমার অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। কুরবানির সময়ও একই কারণে ঠিক এভাবেই তিনি আমাকে এড়িয়ে চলতেন। বাকি সময়টাজুড়ে তিনি আমাকে পরম যত্নে আগলে রাখতেন। টিউশন থেকে ফেরার পরে লেবুর শরবত করে দিতেন। নিজ হাতে ঘামে ভেজা আমার শার্টটি জোর করে শরীর থেকে খুলে নিয়ে ধুয়ে দিতেন। টিউশনে বের হলে প্রচণ্ড শীতেও তার গায়ের চাদর আমাকে জড়িয়ে দিতেন। রাতে মশারি টানানো থেকে শুরু করে আমার যাবতীয় কাজ তিনিই বেশি করে দিতেন। তবে রোজার মাসে আমার সঙ্গে গুরুতরভাবে শত্রু শত্রু খেলা খেলতেন।
পুরো রোজার মাস জুড়ে যখন আমার অন্য ভাই-বোনেরা বাবার থেকে যথেষ্ট সান্নিধ্য পেতো তখন আমি তার কাছে অবহেলায় থাকতাম। নীরবে, নিভৃতে বাবার এই পরিবর্তনকে মুখ বুজে সহ্য করতাম। যখন দশটি রোজা শেষ হয়ে যেত তখন থেকে বাবা অদ্ভুত রকমের কাজ শুরু করতেন। তার পুরনো পাঞ্জাবি ও লুঙ্গিগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিবার বাজার থেকে ইস্ত্রি করে আনতেন। টিউশনে গেলে সেগুলো আমার রুমে জড় করে রাখতেন। যেন ওসব আমার চোখে পড়ে এবং বুঝতে পারি তার অজস্র নতুন নতুন লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি আছে। এবছর তাকে যেন নতুন লুঙ্গি-পাঞ্জাবি কিনে দিয়ে টাকা অপচয় না করি।
টিউশনির টাকায় বাবার চিকিৎসা খরচ চলতো। প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনাকেও বাবা অপচয় মনে করতেন। ওষুধ শেষ হয়ে গেলেও বলতেন না। ওষুধের বাক্সগুলো পুরনো ওষুধের খোসা দিয়ে ভারী করে রাখতেন। যাতে বুঝতে পারি বাক্সগুলো ওষুধে ভরা।
রাতে টিউশনে বের হলে আমার নিরাপত্তার জন্য টিউশন বাসার আশেপাশে বাবা ঘুরঘুর করতেন। টিউশন ছুটি হওয়ার পরে দূরত্ব বজায় রেখে আমার পিছু পিছু বাসায় ফিরতেন। আমাকে এগিয়ে দিতে ও নিতে হাজারবার বাবাকে বারণ করেছি। তবুও লুকিয়ে লুকিয়ে যেতেন। কোথায় গেছিলেন জানতে চাইলে মুখে একরাশ হাসির ঝিলিক দিয়ে বলতেন, ‘রাতের ব্যায়াম শরীরের জন্য যথেষ্ট উপযোগী তাই বাড়ির আঙিনায় তাই হাঁটাহাঁটি করেছি!’
আমাদের সামান্য জ্বর, কাশি বা সর্দি হলেও বাবার কান্নায় এলাকা ভারী হয়ে যেতো। একবার আমার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ভাইটির চিকনগুনিয়া হয়েছিল। তার চিকিৎসার জন্য বাবা জমি বন্ধক রাখার পায়তারা করেছিলেন। অথচ তার গুরুতর হার্টের সমস্যা আমাদের কাছে চেপে রেখেছেন। নিয়মিত ওষুধ সেবন না করে দশ দিনের ওষুধের সময়কে তিনি পনের দিনে নিয়ে যেতেন।
বাবার সব ফাঁকিবাজি আমি নিমিষেই ধরে ফেলতাম। ওষুধের অনিয়মের জবাবদিহি চাইতাম। তার বিপরীতে গিয়ে সবচেয়ে দামি লুঙ্গি ও পাঞ্জাবিটা বাবাকে কিনে দিতাম। ঈদ কিংবা কুরবানিতে নতুন পোশাক পরে বাবা খুশিতে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতেন। তখন আর আমাদের খেয়ালই করতেন না। নিজ হাতে কুরবানির গরু জবাই করতেন। মাংস বন্টন করতেন। অথচ নতুন পোশাক কিছুতেই শরীর থেকে খুলতেন না।
বাবা খরচকে তার ‘ফাঁকিবাজি’ দিয়ে আমাদের সুখ-শান্তিকে আরো ত্বরান্বিত করতে চেয়েছেন। নিজের যাবতীয় সুখ উৎসর্গ করে আমাদের সুখে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছেন। আমার টিউশন করে উপার্জিত অর্থকে হিসাব করে খরচ করাকে তিনি দায়িত্ব মনে করতেন। আর বলতেন, তিনি মারা গেলে তার পেছনে যে অযথাই টাকা খরচ হচ্ছে; তা দিয়ে আমরা আরও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবো!
এখন আর আমার রুমে বাবার পুরনো পোশাক ইস্ত্রি করে স্তূপাকারে রাখা নেই। ওষুধ নিয়ে বাবার ফাঁকিবাজি নেই। খাবার নিয়ে বাবার ফাঁকিবাজি নেই। মশারি টাঙানোয়ও বাবার কোনো অবদান নেই। এক সপ্তাহ ধরে নটরডেম কলেজে পড়ুয়া আমার ছোট্ট ভাইটি অসুখে ভুগলেও এলাকাবাসী বাবার গগনবিদারী কান্নার চিৎকার শোনেনি। এবার ইদে নতুন পোশাকে বাবা পাড়াময় ঘুরে বেড়াবেন না।
গত ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে বাবা পরপারে চলে গেছেন। তার এই ফাঁকিবাজিতে আমরা কি আরও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে পেরেছি? তার এই বড় ‘ফাঁকিবাজি’কে আমি না দেখার ভান করে থাকবো। তিনি আমাদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছেন সদা জাগ্রত হয়ে।