বাংলাদেশ ব্যাংকের নথিও জাল করেন পাপুলের স্ত্রী-কন্যা
অর্থপাচার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক আরেফিন আহসান মিঞা স্বাক্ষরিত নথিও জালিয়াতি করেছেন কুয়েতে গ্রেপ্তার লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও তাদের মেয়ে ওয়াফা ইসলাম।
পাপুলের স্ত্রী সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। ওই উপপরিচালকের ‘স্বাক্ষর’ ও মন্তব্য জালিয়াতির মাধ্যম নিজেদের দায়মুক্তি দিয়ে হাইকোর্টে নথি জমা দেন পাপুলের স্ত্রী-কন্যা।
রোববার (২৪ জানুয়ারি) হাইকোর্টে দাখিল করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নথিটি ২০২০ সালের ১৯ জুলাই মো. আরেফিন আরেফিন মিঞা থেকে স্বাক্ষর করা।
আবার জালিয়াতি নথিতে ‘সার্বিক মতামত’ অংশে পাপুলের স্ত্রী-কন্যাকে দায়মুক্তি দেওয়াসহ অসংখ্য বর্ণনা থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল নথিতে রয়েছে মাত্র দুই লাইনের মন্তব্য। মূলত এই অংশে জালিয়াতি করে নিজেদের দায়মুক্তি দিয়েছেন পাপুলের স্ত্রী-কন্যা।
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও টাকা পাচারের অভিযোগের মামলায় কুয়েতে গ্রেপ্তার হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। একই মামলায় পাপুলের স্ত্রী সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন। ওই জামিন আবেদনের সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নথি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। কিন্তু তলবের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি হাইকোর্টে এলে পাপুলের স্ত্রী-কন্যার জামিনের জন্য জমা দেওয়া নথিতে ধরা পড়ে জালিয়াতির বিষয়টি।
জামিন চেয়ে তাদের পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছিল সেটিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সে প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক মো. আরেফিন আহসান মিঞার কোনো স্বাক্ষর ছিল না।
স্বাক্ষরের জায়গায় ‘অস্পষ্ট স্বাক্ষর’ রয়েছে। জাল করা প্রতিবেদনে স্বাক্ষরের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ সালের ৯ জুলাই। তবে এ ধরনের প্রতিবেদন জামিন আবেদনের সঙ্গে পৃথকভাবে সংযুক্ত করার নিয়ম থাকলেও সেটিরও অপব্যবহার করা হয়েছে।
প্রতিবেদনটির বিষয়ে অসঙ্গতি দেখা দেওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে মূল নথি তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। ওই নির্দেশনা ধারাবাহিকতায় পাপুলের স্ত্রী-কন্যার বিষয়ে তদন্তের মূল প্রতিবেদন দাখিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নথি জালিয়াতির বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, দাখিল করা প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে আমাদের কাছে নথি জালিয়াতির বিষয় উঠে এসেছে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি শাহেদ নুর উদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে এই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হবে।
এর আগে, ১২ জানুয়ারি শহিদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও তার মেয়ে ওয়াফা ইসলামের অর্থপাচার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক আরেফিন আহসান মিঞা স্বাক্ষরিত সমস্ত নথি তলব করেন হাইকোর্ট।
ওই দিন আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেছিলেন, সেলিনা ইসলাম ও তার মেয়ে ওয়াফা ইসলামের অর্থপাচার বিষয়ে দায়মুক্তি দেয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক আরেফিন আহসান মিঞা স্বাক্ষরিত সমস্ত নথি তলব করেছেন হাইকোর্ট। অর্থপাচারের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আদালত মূল নথি তলব করেছেন আদালত।
এর আগে, একই আদালত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ও তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামসহ চার জনের ৬১৭টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ এবং ৯২টি তফসিলভুক্ত স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেন।
এদিকে, মানবপাচারের শিকার পাঁচ বাংলাদেশির অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ৬ জুন মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক পাপুলকে গ্রেপ্তার করে সে দেশের পুলিশ।
পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর গত ১১ নভেম্বর তিনিসহ তার স্ত্রী এমপি সেলিনা, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং মেয়ে ওয়াফা ইসলামের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত বছরের ২৬ নভেম্বর অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের মামলায় পাপুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন।
তাতে অভিযোগ করা হয়, পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধান দুই কোটি ৩১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
এছাড়া ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠানের’ আড়ালে জেসমিন পাঁচ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ১৪৮ কোটি টাকা হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং করেছেন বলে অভিযোগে বলা হয়।
এসব কাজে পাপুল, তার স্ত্রী ও মেয়ে সহযোগিতা করেন উল্লেখ করে তাদেরও আসামি করা হয়।
গত ২২ ডিসেম্বর বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাদের জামিন নামঞ্জুর করে ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। ২৭ ডিসেম্বর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান তারা।
এমএইচডি/এফআর