আপিল শুনানিতে আর কত অপেক্ষা
২০১৯ সালে পরপর দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশকে নাড়িয়ে দেয়। একটি বহুল আলোচিত ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, অপরটি বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা। নিম্ন আদালতে উভয় হত্যা মামলার রায় হয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলা দুটি ঝুলে আছে। কাঙ্ক্ষিত বিচারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছে বাদী ও বিবাদীপক্ষ।
উচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করে অনেক আগেই বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। অভিযোগ আছে, আলোচিত এ মামলার আপিল দ্রুত শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে, এক বছর আগে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও নথি হাইকোর্টে এলেও তা সংশ্লিষ্ট দফতরেই পড়ে আছে। আলোচিত এ মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুত করে অনেক আগেই বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। অভিযোগ আছে, আলোচিত এ মামলার আপিল দ্রুত শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের তেমন উদ্যোগ নেই। অন্যদিকে, এক বছর আগে রিফাত শরীফ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও নথি হাইকোর্টে এলেও তা সংশ্লিষ্ট দফতরেই পড়ে আছে। এখনো পেপারবুক প্রস্তুতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ ছিল। এ কারণে অনেক আলোচিত মামলার আপিল শুনানি শুরু করা সম্ভব হয়নি। অবকাশ শেষে ২১ অক্টোবর থেকে নিয়মিত আদালত চালু হবে। আমরা তখন নুসরাত হত্যা মামলার আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য আদালতে উপস্থাপন করব।
রিফাত শরীফ হত্যা মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পেপারবুক প্রস্তুত করে বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেব। এক্ষেত্রে ‘রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির’ বিষয়টি তিনি নাকচ করে দেন। বলেন, ‘আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল দ্রুত নিষ্পত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ সদা তৎপর। আমাদের কোনো গাফিলতি নেই।’
নুসরাত হত্যা মামলা
২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর নুসরাত হত্যা মামলার রায় দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদরাসাছাত্রী নুসরাতকে হত্যার দায়ে বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর ডেথ রেফারেন্সের জন্য মামলার রায়সহ নথিপত্র হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে। মামলার পেপারবুক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রস্তুত শেষে ২০২০ সালের ২ মার্চ আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি। নুসরাত হত্যা মামলায় দণ্ডিত সব আসামি আপিল করেছেন।
২০১৯ সালের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় সোনাগাজী থানায় নুসরাতের মা শিরিনা আক্তারের করা মামলায় অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ৬ এপ্রিল মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় বোরকা পরা দুর্বৃত্তরা।
২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নুসরাতের মৃত্যু হয়। অগ্নিসন্ত্রাসের এ ঘটনায় নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান (নোমান) সোনাগাজী থানায় মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তরিত হয়।
এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদরাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল।
নুসরাত হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৬ আসামি হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদরাসার বরখাস্ত হওয়া অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি রুহুল আমিন, সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর মাকসুদুল আলম, মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের, প্রভাষক আফসার উদ্দিন, মাদরাসার ছাত্র নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ যোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, কামরুন নাহার মণি, উম্মে সুলতানা পপি ওরফে তুহিন, আবদুর রহিম শরিফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, মোহাম্মদ শামীম ও মহি উদ্দিন শাকিল
নুসরাত হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ চার আসামির আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে আসামিদের পক্ষে আপিল দায়ের করেছি। আমরা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বে থাকা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ বলেন, ফেনীর বিচারিক আদালত ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। উচ্চ আদালতেও যেন আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে সে বিষয়ে আইনি যুক্তি তুলে ধরব। আমাদের প্রস্তুতিও আছে।
রিফাত হত্যা মামলা
বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথি গত বছরের (২০২০ সাল) ৪ অক্টোবর হাইকোর্টে আসে। এক বছর পার হলেও তা সংশ্লিষ্ট দফতরে পড়ে আছে। আপিল শুনানির জন্য পেপারবুকও প্রস্তুত হয়নি।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর রিফাত হত্যা মামলায় মিন্নিসহ ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড এবং চারজনকে খালাস দেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান।
ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। পাশাপাশি তাদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।
রিফাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) ও আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। পাশাপাশি তাদের সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়
বেকসুর খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর গত ৪ অক্টোবর আসামিদের ডেথ রেফারেন্সের নথিসহ মামলার যাবতীয় নথি হাইকার্টে আসে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৪ ধারা অনুযায়ী বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন প্রয়োজন। দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে গত ৬ অক্টোবর আইনজীবীর মাধ্যমে হাইকোর্টে আপিলের আবেদন করেন মিন্নি। ৪৫১ পৃষ্ঠার ওই আবেদনে খালাস চেয়ে ২০টি গ্রাউন্ড (যুক্তি) তুলে ধরা হয়।
গত বছরের ৪ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ আপিলটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচারিক আদালতে মিন্নিকে দেওয়া অর্থদণ্ড স্থগিতের আদেশ দেন। একই মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া মোহাইমিনুল ইসলাম ওরফে সিফাতের আপিল আবেদনও শুনানির জন্য গ্রহণ করে তাকে দেওয়া অর্থদণ্ড স্থগিত করেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর রিফাত হত্যা মামলায় ২৪ জনকে আসামি করে দুটি ভাগে চার্জশিট দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং ১৪ জনকে শিশু আসামি হিসেবে উল্লেখ করা হয় চার্জশিটে।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে রিফাত শরীফকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে নয়ন বন্ডের গড়া কিশোর গ্যাং ‘বন্ড গ্রুপ’। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২ জুলাই মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ক্রসফায়ারে মারা যান।
এ মামলায় প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি হন রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তার আইনজীবী জেড আই খান পান্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা মিন্নির খালাস চেয়ে আপিল দায়ের করেছি। মিন্নির পক্ষে আপিল শুনানি করতে আমি ও আমার টিম প্রস্তুত আছি। মিন্নিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আমরা আদালতে যুক্তিতর্ক তুলে ধরব।
এমএইচডি/এমএআর/এমএইচএস