উচ্চ আদালতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন ৯ নারী বিচারপতি

দেশের বিচার বিভাগে রয়েছে নারীদের দৃপ্ত পদচারণা। বিচারকার্যের মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করছেন তারা। দেশের অধস্তন আদালতে মোট ২১৭৯ জন বিচারকের মধ্যে ৬২৫ নারী বিচারক কর্মরত রয়েছেন। অধস্তন আদালতে নারী বিচারকের সংখ্যা আশা জাগানিয়া। উচ্চ আদালতে প্রায় ১০০ বিচারপতির মধ্যে বর্তমানে ১০ জন নারী বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় একজন বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। ৯ জন নারী বিচারপতি দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তারা সবাই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত। আলোচিত ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রায় দিয়ে দেশজুড়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তারা। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিও হবেন নারী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধস্তন আদালতের তুলনায় উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতির সংখ্যা কম। উচ্চ আদালতে আরও নারী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিচার বিভাগে নারীদের অবদান অনেক। নারীরা মায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিচারকের দায়িত্বও পালন করছেন। দেশের অধস্তন আদালতে ২১৭৯ বিচারকের মধ্যে ৬২৫ জন নারী। এটা খুবই বড় সংখ্যা। আমরা যখন প্রথম বিচার বিভাগে ঢুকেছিলাম তখন ৩ নারী বিচারক ছিলাম। এখন তো অধস্তন আদালতে তিনভাগের এক ভাগ নারী বিচারক।
আরও পড়ুন
এছাড়া প্রতি বছর জুডিশিয়াল সার্ভিসের সব পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম দিকে নারীরাই থাকেন। আশাকরি অধস্তন আদালতের ঢেউ উচ্চ আদালতেও লাগবে। বর্তমানে উচ্চ আদালতে নারী বিচারপতি ১০ জন। আনুপাতিক হারে এ সংখ্যা একেবারেই কম। আমার জানামতে অধস্তন আদালতে উচ্চ আদালতে নিয়োগ দেওয়ার মতো অনেক নারী বিচারক রয়েছেন। আবার আইনজীবীদের মধ্যেও অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন নারী আছেন। সেখান থেকেও উচ্চ আদালতে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। আমি সরকারের কাছে দাবি করব উচ্চ আদালতে যেন নারী বিচারপতির সংখ্যা বাড়ানো হয়। আমি নারীদের নিয়ে অনেক আশাবাদী। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নারী প্রধান বিচারপতি পাবে—এটা আশা করতেই পারি।
উচ্চ আদালতের ৯ নারী বিচারপতি
বিচারপতি ফারাহ মাহবুব : বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও এলএলএম পাসের পর ১৯৯২ সালে জেলা আদালতে আইন পেশা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টে এবং ২০০২ সালের ১৫ মে আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালের ২৩ আগস্ট তিনি হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি নিযুক্ত হন। ২০০৬ সালে তিনি হাইকোর্ট বিভাগে পূর্ণাঙ্গ বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। তার আরও একটি পরিচয় তিনি সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মেয়ে।
আজিমপুর কবরস্থান রক্ষার রায়, ধর্ষণের শিকার নারীদের দ্রুত মামলা নেওয়ার বিষয়ে নীতিমালা করে রায়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রথাগত অধিকার রক্ষার রায়, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর ঘটনায় শিশু জিহাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণের রায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্যানেল শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণের রায়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা বাধ্যতামূলকের রায়সহ অসংখ্য আলোচিত রায় দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন তিনি।
বিচারপতি ফাতেমা নজীব : নরসিংদীর জেলা ও দায়রা জজ বেগম ফাতেমা নজীব ২০১৮ সালের ৩০ মে হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২০ সালের ৮ জুন তাকে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি ১৯৮৪ সালে মুন্সেফ হিসেবে বিচার বিভাগে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া হংকং, থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কাসহ বেশকিছু দেশ ভ্রমণ করেন।
বিচারপতি কাজী জিনাত হক : একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক একুশে পদকপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. শরীফা খাতুনের কনিষ্ঠ কন্যা বিচারপতি কাজী জিনাত হক। তিনি দুই মেয়াদে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর কাজী জিনাত হক হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
বিচারপতি ফাহমিদা কাদের : নাটোরের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান ফাহমিদা কাদের কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৮১ সালে ঢাকার অগ্রণী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৩ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (সম্মান) ডিগ্রি নেন। তিনি আইন বিভাগের ১১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। ১৯৯১ সালের ১১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে সহকারী জজ (প্রবেশনার) হিসেবে যোগ দেন। বিচারক নিয়োগের ওই পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অর্জন করে নিজ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। সেখান থেকেই শুরু বিচারিক জীবনের পথ চলা।
সহকারী জজ হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাঁচ বছর পরই ১৯৯৬ সালে প্রথম পদন্নোতি পেয়ে সিনিয়র সহকারী জজ হিসেবে কুমিল্লার আদালতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে দ্বিতীয় পদোন্নতি পেয়ে যুগ্ম জেলা জজ হিসেবে চাঁদপুরে যোগ দেন। ২০০৪ সালে অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালে সিলেটের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালে জেলা জজ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে বিভাগীয় স্পেশাল জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত টাঙ্গাইলের জেলা জজ ও দায়রা জজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে সততা ও দক্ষতার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালন করার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২২ সালের ৩১ জুলাই তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাকে এই নিয়োগ দেন। বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি বাংলাদেশ ওমেন জাজেস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ফাহমিদা কাদেরের স্বামী মকবুল আহসান টিটো ছিলেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ। তিনি এখন অবসরে আছেন। এই দম্পতির তিন সন্তান। তারা পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্রে চাকরি করছেন। ফাহমিদা কাদের ভারত, ইউএসএ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনারে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
বিচারপতি মুবিনা আসাফ : মুবিনা আসাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে আইন-পেশায় যোগদান করেন। ১৯৯৩ সালে জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি আইনপেশার শুরুতে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসে কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে হাইকোর্টে ও ২০০৯ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন তিনি। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত তিনি সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিচারপতি মুবিনা আসাফ ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন।
গত বছরের ৮ অক্টোবর বিচারপতি মুবিনা আসাফকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতি নাসরিন আক্তার : তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে আইনপেশায় যোগদান করেন। ১৯৯৭ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্য নির্বাহী সদস্য, সিনিয়র সহ-সম্পাদক ও ট্রেজারার হিসেবে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন নাসরিন আক্তার।
গত বছরের ৮ অক্টোবর তাকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকা : আইনুন নাহার সিদ্দিকার গ্রামের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ায়। বাবা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। ২০০০ সালে তিনি জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৪ সালে হাইকোর্ট বিভাগের ও ২০২০ সালে আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইনজীবী হিসেবে উচ্চ আদালতে জনস্বার্থে বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করেছেন। গত বছরের ৮ অক্টোবর তাকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতি তামান্না রহমান : বিচারপতি তামান্না রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে আইনপেশায় যোগদান করেন। তিনি ১৯৯৫ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০১৫ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলএলএম ল’ ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। গত বছরের ৮ অক্টোবর তাকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতি সাথিকা হোসেন : সাথিকা হোসেন ১৯৯৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০০৩ সালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ লাভ করেন।গত বছরের ৮ অক্টোবর তাকে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এমএইচডি/এসএম