আমার গল্প শুনলে সবার হৃদয় কাঁদবে, আদালতকে মতিউর
‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে ওএসডি করা হয়। গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে রাসেলস ভাইপার সাপ আতঙ্ক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে ছাগলকাণ্ডে আমার পরিবারকে ভাইরাল করে তৎকালীন সরকার। আমার গল্প শুনলে প্রত্যেকটা হৃদয় কাঁদবে।’
ঠিক এভাবেই কান্নারত অবস্থায় আদালতের উদ্দেশ্যে এসব কথা বলেন আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাকে সিএমএম আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। এদিন বেলা ৫টায় তাকে আদালতে তোলা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপপরিদর্শক রুবেল মিয়া মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।
শুনানিতে তিনি বলেন, ‘মতিউরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থাকায় দুদক মামলা দায়ের করেছে। আজ (বুধবার) তার স্ত্রীকে সেই মামলায় কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন মহানগর দায়রা জজ আদালত। এই মতিউর আওয়ামী ফ্যাসিস্ট রেজিমে সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম। তার হাত ধরে হাজার-হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। দুদকের মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে অভিযান চালালে তার বাসা থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়। এই অস্ত্র বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে ব্যবহার হয়েছে কিনা, তা খতিয়ে দেখতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। আমরা তার সর্বোচ্চ ১০ দিনের রিমান্ড চাই।’
এ সময় আসামিপক্ষে অ্যাডভোকেট আবু সুফিয়ান তার রিমান্ড বাতিল চেয়ে শুনানি করেন। তিনি বলেন, ‘আসামি মতিউর তার নিজ যোগ্যতাবলে এনবিআরের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের দেওয়া উপহারে অনেক টাকা অর্জন করেছেন। তার অবৈধ কোনো সম্পদ নেই। আর আজ যে মামলায় তার রিমান্ড চাওয়া হয়েছে, সেখানে রিমান্ডে নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তিনি টেস্ট কেস হিসেবে এক রাউন্ড গুলি ফায়ার করেছিলেন, তবে কোনো জিডি করেননি। আর যে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে সেটা লাইসেন্স করাই ছিল তবে নবায়ন করা ছিল না। রিমান্ডে নিলে তিনি এসব কথাই বলবেন।’
শুনানি চলাকালে মাগরিবের আজান হলে মতিউরের আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘তিনি (মতিউর) রোজা ছিলেন।’ এ সময় আদালতের উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা তাকে পানি পান করান।
এরপর আদালত মতিউরের বক্তব্য শুনতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কাস্টমস থাকাকালীন কাস্টমের অটোমেশন হয়। আমি আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নেইনি। বরং আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে আমাকে ওএসডি করা হয়। আমাকে শিবির ক্যাডার তকমা দিয়ে প্রায় দেড় বছর ওএসডি করে রাখে সরকার। পরবর্তীতে আমি পুনরায় চাকরিতে যোগদান করি।’
আরও পড়ুন
আদালতকে তিনি আরও বলেন, ‘আমার দেওয়া সিদ্ধান্তে পোশাক খাতে সরকারের ২৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পায়। আমার এসব উদ্যোগের জন্য তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে হয়। আমাকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হয়। একপর্যায়ে আমাকে জোর করে রাজস্ব আপিলেট ট্রাইব্যুনালে বসায়।’
‘এখানে কোনো আইনজীবী বলতে পারবে না ট্রাইব্যুনালে থাকা অবস্থায় আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি। ট্রাইব্যুনালের ১২ হাজার মামলাজট নিষ্পত্তি করেছি। মূলত তখনকার রাসেলস ভাইপার সাপ আতঙ্ক থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে ছাগলকাণ্ডে আমার পরিবারকে জড়ানো হয়। আমি ৬ বছর যাবৎ সেই ছেলের কাছ থেকে ডিটাচড্ (আলাদা) ছিলাম। এই সুযোগে সরকার গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে আমার ১৬ বছরের ছেলেকে দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন করে।’
একপর্যায়ে কান্নারত অবস্থায় তিনি বলেন, ‘সব কথা তো বলতে পারছি না। তবে আমার গল্প শুনলে প্রত্যেকটা হৃদয় কাঁদবে। কোনো কিছু না জেনে দয়া করে একটা ফ্যামিলিকে ধ্বংস করবেন না। ইনশাআল্লাহ, আমাদের ফ্যামিলির বিরুদ্ধে মামলা টিকবে না।’
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘টেস্ট করতে আমি একটি মিসফায়ার করেছিলাম। তবে এ বিষয়ে জিডি না করাটা আমার মিস্টেক (ভুল) হয়েছে।’
এরপর আবারও প্রসিকিউটর ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন। পরে আদালত তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদেশ দেন।
জানা গেছে, দুদকের রিক্যুইজিশনে ডিবি পুলিশ মতিউর রহমানকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। অবস্থান শনাক্ত করে বুধবার সকাল পৌনে ৭টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তার বাসায় অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। এরপর জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অস্ত্র রাখার কথা স্বীকার করেন। এ সময় শয়নকক্ষের আলমারি থেকে একটি বিদেশি পিস্তল বের করে দেন মতিউর।
এ ঘটনায় ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক বেলাল হোসেন বাদী হয়ে ভাটারা থানায় অস্ত্র আইনে মামলা করেন।
এদিন মতিউরের রহমানের সঙ্গে তার স্ত্রী লায়লা কানিজকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দুদকের মামলায় আজ তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আগামী ১৯ জানুয়ারি তাকে সাত দিনের রিমান্ড নেওয়ার আবেদনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এনআর/এমজে