‘তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়’
সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু আলোচিত বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে করা রিটের রুল শুনানিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা একথা বলেন।
তত্ত্বাবধায়ক (কেয়ারটেকার) সরকারের মাধ্যমে দেশে যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল উল্লেখ করে শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা সংবিধান থেকে বিলোপ করায় বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল করে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়েছে। সংবিধানের বুকে কুঠার আঘাত করা হয়েছে।’
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকে মানুষের অধিকার হরণের পদক্ষেপ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংশোধনী সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা। একটি নির্দিষ্ট দলের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা ও ফ্যাসিজমকে প্রতিষ্ঠা করতেই ত্রয়োদশ সংশোধনীকে পাশকাটিয়ে (বাইপাস করে) এই সংশোধনী আনা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রসঙ্গ টেনে শুনানির একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এই নয় যে, হাজার হাজার মানুষকে গুম করা। বিচার বহির্ভূত খুন করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানে এটা নয় যে, ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এগুলো হতে পারে না।
আরও পড়ুন
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা জাতির পিতার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘উনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন। ওনার অবদান অনস্বীকার্য। তবে আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় আমরা (উই) বলা হয়েছে। সেখানে একক কোনো ব্যক্তি প্রাধান্য নেই, ব্যক্তিপূজার সুযোগ নেই।’
মানুষকে ভয়ের সংষ্কৃতিতে রাখা, মানুষের কণ্ঠ রোধ করা ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে দূরে রাখতেই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ (এ) (বি) আনা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি মৌলিক অধিকারসহ সংবিধানে থাকা নাগরিকদের অধিকারকে আঘাত করেছে। পার্লামেন্টের সুপ্রিমেসিকে আঘাত করেছে। ডিকটেটরশিপকে টিকিয়ে রাখার জন্যই এটি করা হয়েছে।’
এদিকে, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোটের বিধানটি বাতিল করে মৌলিক বিষয়ে জনগণের মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল গণভোটের বিধানটি পুনর্বহালের পক্ষে শুনানিতে যুক্তি তুলে ধরেন।
এছাড়া, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা বাঙালি জাতির বিষয়টির মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, টেরিটোরিয়াল জুরিডিকশন অনুযায়ী দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি পরিচয়ই একক ও অভিন্ন। আর আমাদের এখানে ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষও রয়েছেন যারা বাঙালি না। তাই সংবিধানে বাঙালি জাতি উল্লেখ থাকলে তারাও এটার মধ্যে চলে আসতে বাধ্য হয়।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ৭ মার্চের ভাষণ ও মুজিবনগর সরকার সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংবিধানের অংশ হওয়ার যোগ্য না উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল প্রখ্যাত আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামের বইয়ের রেফারেন্স তুলে ধরেন।
সমাজতন্ত্র নয় গণতন্ত্রই আমাদের সংবিধানের মূল স্পিরিট উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিতে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসই হবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’কে পুনর্বহালের যুক্তি তুলে ধরেন।
বুধবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রুলের পঞ্চম দিনের শুনানি শেষ হয়। এদিন অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানির পর শুনানি শুরু করেন জামায়াতের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
রুলে শুনানিতে সুজনের পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া। বিএনপির পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল। ইনসানিয়াত বিপ্লব দলের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আব্দুর রউফ ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন।
এমএইচডি/এসএম