হাইকোর্টের আদেশের পরও ‘টাউট’ কুদরতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে গড়িমসি
![হাইকোর্টের আদেশের পরও ‘টাউট’ কুদরতের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে গড়িমসি](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2024June/kudrat-20240630173322.jpg)
টাঙ্গাইল জেলা সমবায় ব্যাংকের সভাপতি ও আদালত অঙ্গনে ‘টাউট’ হিসেবে পরিচিত কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গত বছরের ২০ জুন নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তিন মাসের মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) বিষয়টি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। হাইকোর্টের এ আদেশের এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেনি দুদক। এ বিষয়ে শুধু চিঠি চালাচালির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া, অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিলের কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে গত ২১ মার্চ ইচ্ছাকৃতভাবে রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করার অভিযোগে কুদরত ই এলাহির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। প্রতিষ্ঠানটির টাঙ্গাইল জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ফেরদৌস রহমান মামলাটি দায়ের করেন।
রোববার (৩০ জুন) রিটের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রাফসান আলভী ঢাকা পোস্টকে বলেন, কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের ‘নিরবতা’ নানান প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। দুদক আইনের ২৭ ধারায় তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা দায়ের করার কথা। কিন্তু তা না করে ইচ্ছাকৃতভাবে রেকর্ডপত্র সরবরাহ না করার অভিযোগে দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করতে প্রতিষ্ঠানটির সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমরা খুব শিগগিরই কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনেও অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল না করার বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা মো. ফেরদৌস রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।
গত বছরের ২০ জুন টাঙ্গাইল জেলা সমবায় ব্যাংকের সভাপতি কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তিন মাসের মধ্যে দুদককে বিষয়টি অনুসন্ধান করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব, ব্যারিস্টার অনীক আর হক, অ্যাডভোকেট রাফসান আলভী ও ব্যারিস্টার শেখ মো. সামিউল ইসলাম জুয়েল। দুদকের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সাজ্জাদ হোসেন।
সেদিন শুনানিতে আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, কুদরত ই এলাহি খান একজন টাউট, রাজনৈতিক প্রভাব ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে অন্যের সম্পত্তি বেআইনিভাবে দখলদার। তাছাড়া, তিনি আইনজীবী না হয়েও মামলার দালাল হিসেবে পরিচিত। চুক্তির মাধ্যমে আদালতের আদেশ পাওয়ার ঘোষণা দিয়ে থাকেন। পিটিশনার ব্যারিস্টার এম আশরাফুল ইসলামকে এর আগে তিনি হুমকিও দিয়েছেন। তিনি গর্ব করে বলে থাকেন, অনেক ব্যারিস্টার, আইনজীবী এমনকি বিচারকদের পকেটে রাখেন। এর আগে তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে।
এর আগে, টাঙ্গাইলের বাসিন্দা ব্যারিস্টার মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম রাহেলা জাকির টাঙ্গাইল জেলা সমবায় ব্যাংকের সভাপতি কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে এ রিট দায়ের করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, টাঙ্গাইল জেলা সমবায় ব্যাংকের সভাপতি কুদরত ই এলাহি খানের বিরুদ্ধে ব্যাংকটির ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না সমবায় অধিদপ্তর। স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দুর্নীতির বিষয়টি আমলে নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে তাগিদ দিয়েছে। অডিট রিপোর্টে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তারপরও লুটপাটকৃত অর্থ আদায়ের কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বহুতল ব্যাংক মার্কেট নির্মাণ এবং বিক্রি বন্ধের আদেশ তুলে দিয়ে নতুন করে দুর্নীতির আরও সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল সমবায় ব্যাংকের সভাপতি পদে ২০১৫ সালে মেয়াদ শেষ হয়েছে কুদরতের। কমিটির মেয়াদ শেষে অ্যাডহক কমিটি গঠন করে নির্বাচনও দেওয়া হয়। মনোনয়ন বিক্রি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে গোলযোগ সৃষ্টি হলে নির্বাচন স্থগিত এবং অ্যাডহক কমিটির বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা করেন কুদরত ই এলাহি। সেই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। মামলার রায়ের সুযোগ নিয়ে ১০ বছর ধরে সভাপতি পদে বহাল তবিয়তে আছেন তিনি।
জানা গেছে, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের নিজস্ব শূন্য দশমিক ৮১ একর জায়গার ওপর একটি দ্বিতল মার্কেট ভবনে ১৫৫ জন ব্যবসায়ীকে দোকান বরাদ্দ দেয় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ওই ১৫৫ জন ব্যবসায়ী বরাদ্দকৃত দোকানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের সভাপতি কুদরত ই এলাহির সঙ্গে সখ্য করে পারস্পরিক যোগসাজশে সমবায় ব্যাংকের তহবিল তছরুপ করাসহ মার্কেট ভবন নির্মাণের নামে ১১ কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দেন সমবায় অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কুদরত ই এলাহিকে ব্যবহার করে অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা নানা সুবিধা নিয়েছেন, নতুন করে আরও সুবিধা নিতে মার্কেটের ৪, ৫ ও ৬ তলার দোকান বিক্রির আদেশ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুদরত ই এলাহি তার পরিষদকে পাশ কাটিয়ে চাচাতো বোনজামাই দিদারুল ইসলামকে দিয়ে সমবায় ব্যাংকের একটি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করছেন। সূত্র জানায়, গত পাঁচ মাসে এ হিসাব থেকে কুদরত প্রায় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। আইন লঙ্ঘন করে দিদারকে সই করার ক্ষমতা দেওয়ায় লেনদেন করতে জবাবদিহি করতে হয় না সভাপতিকে। বিষয়টি স্বীকারও করেন হিসাবরক্ষক দিদার। তিনি বলেন, আমাকে সই করার ক্ষমতা দিয়েছেন চেয়ারম্যান, এ বিষয়ে আপনি তার কাছ থেকে জেনে নিলে ভালো হয়।
এছাড়া, সর্বশেষ অডিট রিপোর্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, কুদরত ই এলাহি সভাপতি হিসেবে সমবায় ব্যাংকের তহবিল থেকে ঠিকাদারকে ধার দিয়েছেন ছয় কোটি ৮৫ হাজার ৬৩৪ টাকা। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সমবায় ব্যাংকের কাছে পাঁচ বছর আগের পাওনা এখনো বুঝে পায়নি। এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী বলেন, কুদরত সাহেব আমার পাঁচ বছর আগের পাওনাই দিচ্ছেন না, ধার দেবেন কেন? আমার কাজের টাকা আদায়ের জন্য আমি বারবার তাগাদা দিলেও নানা টালবাহানা করছেন চেয়ারম্যান।
অডিট রিপোর্ট সূত্রে আরও জানা যায়, বিভিন্নভাবে মামলা পরিচালনার জন্য কুদরত ই এলাহি আইনজীবীর খরচ হিসেবে তিন কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। এ অবিশ্বাস্য লেনদেন নিয়ে সমবায় কর্মকর্তারাও প্রশ্ন তুলেছেন। তবে, এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলার সাহস পাচ্ছেন না স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তারা।
এমএইচডি/কেএ