আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা : ২৮ মাসেও প্রস্তুত হয়নি পেপারবুক
২০১৯ সালের অক্টোবরে বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশকে নাড়িয়ে দেয়। ওই ঘটনার দুই বছর পর ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত এই মামলায় ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১। তারপর নিয়ম অনুযায়ী আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এরপর খালাস চেয়ে আপিল করেন আসামিরা। তবে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স আসার ২৮ মাস পেরিয়ে গেছে। এতদিনেও আপিল শুনানির জন্য পেপারবুক প্রস্তুতের কাজ শুরু হয়নি। কবে পেপারবুক তৈরি শুরু হবে, কবে শেষ হবে তার সঠিক তথ্যও নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবরার হত্যা মামলার পেপারবুক তৈরির কাজ এখনও শুরু হয়নি। এই মামলার নথি যাচাই-বাছাইসহ আনুষঙ্গিক কাজ এখন চলছে।
নিয়ম অনুযায়ী পেপারবুক প্রস্তুত শেষ হলে প্রধান বিচারপতি সংশ্লিষ্ট মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন।
উচ্চ আদালতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কয়েকটি আলোচিত, চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির নজির রয়েছে। যেমন- পিলখানার ঘটনায় করা হত্যা মামলা, সৌদি দূতাবাস কর্মকর্তা খালাফ এস আলী হত্যা মামলা ও ব্লগার রাজিব হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়েছিল। সরকার চাইলে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির উদ্যোগ নিতে পারে।
জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, প্রধান বিচারপতি সালের ক্রম অনুযায়ী ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো বিভিন্ন বেঞ্চে নিষ্পত্তির জন্য পাঠাচ্ছেন। সে অনুযায়ী শুনানি হচ্ছে। যেমন আলোচিত ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল শুনানিও শুরু হবে।
চাঞ্চল্যকর মামলা শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতির অভিযোগ নাকচ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের কোনো ধরনের গাফিলতি নেই। চাঞ্চল্যকর মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় পর্যন্ত নেয় না। এসব মামলা হাইকোর্টে দ্রুত নিষ্পত্তি হোক এ বিষয়ে আমরা আন্তরিক।
বিচারিক আদালতের রায়ের পর দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও আপিল শুনানি তো দূরের কথা, এখনও পেপারবুক তৈরি শেষ হয়নি। অভিযোগ আছে, আলোচিত এ মামলার আপিল দ্রুত শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ সাইফুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের কাজ এখনও শেষ হয়নি। পেপারবুক তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। এই মামলার নিম্ন আদালত থেকে আসা সব নথি পরীক্ষা চলছে। আশা করছি শিগগিরই পেপারবুক প্রস্তুতের কাজ শেষ হবে।
২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। এরপরই আসামিরা দণ্ড থেকে খালাস চেয়ে ফৌজদারি আপিল ও জেল আপিল করেন। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়। দণ্ডিত আসামিরা উচ্চ আদালতে ফৌজদারি আপিল এবং জেল আপিল করতে পারেন।
২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনের যাবজ্জীবনের আদেশ দেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামানের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য মোজাহিদুর রহমান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুর রহমান মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাক্কারুল ইসলাম তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান (ওয়াটার রিসোসের্স, ১৬ ব্যাচ), শামছুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), উপ-দপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল) এবং এসএম মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল)।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হলেন- বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ), গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পরের দিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের বাবা বরকত উল্লাহ।
মাত্র ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পরিদর্শক মো. ওয়াহিদুজ্জামান।
এমএইচডি/জেডএস