সন্তানদের ফিরে পেতে হাইকোর্টে আইনি লড়াইয়ে আমেরিকান বাবা
জাপানি মা নাকানো এরিকো ও ভারতীয় মা সাদিকা সাঈদের পর দুই শিশু সন্তানকে ফিরে পেতে আইনি লড়াইয়ে নেমেছেন আমেরিকান বাবা গ্যারিসন লুটেল। দীর্ঘদিন সন্তানদের কোনো খোঁজ-খবর না পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে। সন্তানদের আদালতে হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট দুই শিশু সন্তানসহ তাদের বাংলাদেশি মা ফারহানা করিমকে আদালতে হাজির করতে বলা হয়েছে। উত্তরা থানা পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
গত ২০ নভেম্বর বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দিয়েছেন। ওইদিন আদালতে আমেরিকান বাবার পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ।
পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আইনজীবী ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যবসায়ী গ্যারিসন লুটেল। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফারহানা করিমকে ২০১৮ সালে বিয়ে করেন। ঢাকার উত্তরাতে তাদের বাসা। ফারহানা স্থায়ীভাবে আমেরিকায় বসবাস করেন। তিন বছর আগে তাদের প্রথম একটি সন্তান হয়। যুক্তরাষ্ট্রে ফারহানা ও গ্যারিসনের নিজস্ব বাসা ছিল। এ বছরের শুরুর দিকে ফারহানা আবার অন্তঃসত্ত্বা হন। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় জুন মাসে ফারহানা করিম বাংলাদেশে চলে আসেন। অন্তঃসত্ত্বা সময় তার বোন-মায়ের সঙ্গে থাকা জরুরি এই অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশে আসেন। আসার পর তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। সন্তানদের কথা চিন্তা করে গ্যারিসন ফারহানাকে নিয়মিত টাকা দিয়ে আসছিলেন।
কিন্তু পরে দেখলেন, অনেকদিন হয়ে গেছে যোগাযোগ করছে না। কোনো আপডেট দিচ্ছে না। গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে তিনি চেষ্টা করেছেন যোগাযোগ করতে, কিন্তু পারেননি। যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়ে অক্টোবর মাসে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ফারহানা দেখা করতে চান না, বাচ্চারাও দেখাতে চান না। এক পর্যায়ে উত্তরা থানার পুলিশ ও গ্যারিসন যে হোটেলে থাকতেন তাদের সহযোগিতা নিয়ে ফারহানার বাসায় যান। বাসায় গিয়ে জানতে পারেন, ফারহানা করিম কানাডিয়ান একজন ব্যক্তির সঙ্গে বসবাস করছেন। তিনি কানাডিয়ান ওই ব্যক্তিকে বিয়ে করেছেন বলে দাবি করেন। এদিকে, এক মাস আগে আরেকটি পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন ফারহানা।
আরও পড়ুন
আইনজীবী বলেন, সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, তিনি গ্যারিসনকে হাসপাতালের কাগজ দেখিয়ে বলেছেন দ্বিতীয় সন্তান গ্যারিসনের না। এ সন্তান তার পার্টনার কানাডিয়ান নাগরিকের। তিনি একটা ম্যারেজ ডকুমেন্ট দেখিয়ে বলেছেন, কানাডিয়ান নাগরিককে বিয়ে করেছেন। কিন্তু আমেরিকান নাগরিক গ্যারিসনের সঙ্গে তার এখনো ডিভোর্স হয়নি। গ্যারিসনের বাংলাদেশে আসার অন্যতম কারণ– পুরান ঢাকার একজন কাজী যুক্তরাষ্ট্রে একটি কাগজ পাঠায়। সেটি তালাকের নোটিশ। মুসলিম পারিবারিক আইনে একটি তালাকের নোটিশ পাঠান। নোটিশ দেখে গ্যারিসনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।
ব্যারিস্টার সজীব মাহমুদ বলেছেন, আমরা আদালতে বলেছি, নোটিশটা ইনভ্যালিড। কারণ তাদের বিয়ে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট অব মিজোরির আইন অনুযায়ী। ডিভোর্স হলে স্টেট আইনে হতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আসার পর গ্যারিসন উত্তর সিটি কর্পোরেশনে যান। সিটি কর্পোরেশন থেকে কাগজপত্র দেখে তারা বলেন, আসলে এটা তো এভাবে হয় না। আমরা তারপর কাজীর কাছে গিয়েছি। তিনি খুব বেশি সহযোগিতা করেননি। তিনি আমাদের থেকে একটি দরখাস্ত রেখেছেন। বিয়ে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী। অথচ তিনি নোটিশ পাঠিয়েছিলেন মুসলিম পারিবারিক আইনে, এটা তিনি আইনত পারেন না। আর নোটিশ যখন ইস্যু করা হয়েছে তখন ফারহানা অন্তঃসত্ত্বা। অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় তো নোটিশ পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। নোটিশের বিষয়ে তিনি দেওয়ানি মামলা করেছেন। আর সন্তানদের হাজির করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে হেবিয়ার্স কপার্স রিট করা হয়েছে। রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট দুই শিশু সন্তানসহ তাদের মাকে হাজির হতে বলেছেন। উচ্চ আদালতের আদেশ অনুযায়ী মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) তাদের হাজির হতে হবে।
উল্লেখ্য, দুই কন্যা সন্তানকে নিজের জিম্মায় নিতে জাপানি মা নাকানো এরিকো ২০২১ সালের আগস্ট মাসে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। সন্তানদের অভিভাবকত্ব নিয়ে তাদের জাপানি মা নাকানো এরিকো ও বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের মধ্যে আইনি লড়াই এখনো চলমান। অন্যদিকে, বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে তিন বছরের আইনি লড়াইয়ের পর গত ৬ নভেম্বর ৫ বছরের শিশু সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন ভারতীয় নাগরিক মা সাদিকা সাঈদ। তবে শিশু সন্তানকে নিয়ে আদালতের অনুমতি ছাড়া তিনি বাংলাদেশের বাইরে যেতে পারবেন না। আর বাবা সপ্তাহে দুই দিন সন্তানকে দেখতে যেতে পারবেন।
এমএইচডি/এসএসএইচ