গ্রেনেড হামলা : চলতি বছরেই হাইকোর্টের রায়ের প্রত্যাশা
ইতিহাসের ভয়াবহতম ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার ১৯ বছর পার হতে চলছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলা এখনও হাইকোর্টে ঝুলছে। যদিও বিচারিক আদালত ২০১৮ সালে এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। এরপর আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে তা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে নারকীয় সন্ত্রাসী ওই হামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও পেপারবুক পড়া শেষ হয়নি। ফলে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও অন্যান্য আসামিদের আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, দ্রুতই শেষ হবে এ মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি। যার মাধ্যমে চলতি বছরই হাইকোর্ট থেকে রায় ঘোষণার প্রত্যাশা করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ মামলার পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি অসুস্থ থাকায় আপাতত বেঞ্চ বসছেন না। আশা করি সুস্থ হলেই তিনি বেঞ্চে বসবেন। বেঞ্চ বসলেই আমরা শুনানি শেষ করব। শুনানি শুরু হলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের যুক্তিতর্ক তুলে ধরবেন। পরে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। শুনানি শেষ করতে আমাদের ১০ থেকে ১২ কার্যদিবস লাগবে। এর বেশি লাগবে না।
আরও পড়ুন >> নেতাকর্মীরা আমাকে ঘিরে একটা মানবঢাল তৈরি করে : প্রধানমন্ত্রী
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রের প্রধান এ আইন কর্মকর্তা বলেন, আদালতের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে বিচারিক আদালতের রায় যেন বহাল থাকে। কারণ আমরা বিচারিক আদালতের পুরো রায় পড়েছি। বিচারক যুক্তি তুলে ধরে, আইনকে বিশ্লেষণ করে সুন্দর রায় দিয়েছেন। এই রায়টা বহাল রাখার জন্য আমরা আবেদন করব। তারেক রহমানসহ সব আসামির রায় বহাল রাখার আর্জি জানাব। অক্টোবর মাসের মধ্যে এই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষ হয়ে রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, তারা হাইকোর্টে আইনি যুক্তিতর্ক তুলে ধরে আসামিদের খালাস চাইবেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক পড়া এখনও শেষ হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের পেপারবুক পড়া শেষ হলে আমরা আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করব।
তিনি বলেন, আমরা আদালতের কাছে দুটি প্রার্থনা করব। এক নম্বর হচ্ছে- এই মামলায় ভিকটিম পক্ষ এবং আসামিপক্ষ কেউই বিচার পায়নি তদন্তের দুর্বলতার কারণে। দ্বিতীয় কথা বলব, মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, ভারতীয় উপমহাদেশে এর কোনো নজির নেই। এ কারণে মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে প্রদত্ত যে সাজা এটি আইনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এই যুক্তি উপস্থাপন করে আমরা সাজা থেকে আসামিদের খালাস চাইব।
২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল, জেল আপিল শুনানি শুরু হয়।
বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।
তার আগে ওই বছরের ২৯ অক্টোবর বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল, জেল আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন ওই সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে থাকা হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।
এছাড়া ওই বছরের আগস্ট মাসে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল, জেল আপিল দ্রুত শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ফাঁসি এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। নিম্ন আদালতের রায়ের পর আপিল করেন আসামিরা।
পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় এসে পৌঁছে।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবন দণ্ডিত যারা
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, আরিফুল ইসলাম, জঙ্গিনেতা মুফতি আবদুর রউফ, হাফেজ ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবদুল হান্নান ওরফে সাব্বির, মুরসালিন, মুত্তাকিন, জাহাঙ্গীর বদর, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. ইকবাল, রাতুল আহমেদ, মাওলানা লিটন, মো. খলিল ও শাহাদত উল্লাহ ওরফে জুয়েল।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাড়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
আসামিদের মধ্যে ২২ জন খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। অপরদিকে ১২ জন আসামির জেল আপিল দায়ের হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী। তাদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
এমএইচডি/জেডএস