ই-অরেঞ্জের প্রতারণা : বিএফআইইউর প্রতিবেদন হাইকোর্টে
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান ও ভাই শেখ সোহেল রানার অস্বাভাবিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
বুধবার (২ নভেম্বর) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে বিএফআইইউ-এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ই-অরেঞ্জ.শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর মালিকানায় সোনিয়া মেহজাবিন থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করে পুলিশ কর্মকর্তা (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানার (সোনিয়া মেহজাবিনের ভাই) স্ত্রী নাজনীন নাহার বিথির নামে হস্তান্তর করা হয়। সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানগুলোর নামে অল্প সময়ের ব্যবধানে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মোট ১৩টি হিসাব খুলে লেনদেন পরিচালনা করা হয়েছে। ১৩টি হিসাবের মাধ্যমে জানু ২০১৯ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত সময়ে ১ হাজার ১১১.৪৫ কোটি টাকা জমা ও ১ হাজার ১০৯.৯৭ কোটি টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মোট ২ হাজার ২২১.৪২ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন হয়েছে। হিসাবগুলোতে জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুলাই ২০২১ পর্যন্ত সময়ে অধিকাংশ লেনদেন হয়েছে।
এছাড়া সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মো. মাসুকুর রহমানের নামে সর্বমোট ২৪টি হিসাব পরিচালনা করে লেনদেন সম্পন্ন করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে। ওই ২৪টি হিসাবের মাধ্যমে সময়ে সময়ে সন্দেহভাজন দুই ব্যক্তি প্রায় ১২০ কোটি টাকার লেনদেন সম্পন্ন করেছেন। হিসাব খোলার ফরমের তথ্য অনুযায়ী ই-অরেঞ্জ.শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর ব্যাংক হিসাবের নমিনি ও হিসাব খোলার আবেদনে হিসাবটির পরিচয়দানকারী ছিলেন মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ। একইভাবে, রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এর হিসাব খোলার আবেদন ফরমে পরিচয়দানকারী ছিলেন সোনিয়া মেহজাবিন। আলোচ্য সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠান ৩টির ব্যবসায়িক ঠিকানা একই মর্মে ব্যাংক হিসাবের দলিলাদিতে উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান ৩টির ব্যাংক হিসাবে নিয়মিতভাবে ফান্ড ট্রান্সফার, আরটিজিএস এর মাধ্যমে লেনদেন সংঘটিত হয়েছে মর্মে লেনদেন বিশ্লেষণে পরিলক্ষিত হয়েছে।
ব্যাংক হিসাবে অর্থ জমা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের অংশে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ.শপ ও অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর হিসাবে সম্পন্ন হওয়া লেনদেন পর্যালোচনায় পেমেন্ট গেটওয়ে SOFTWARE SHOP LTD (এসএসএল কমার্স) কর্তৃক মোট ৩ লাখ ৪ হাজার ৫২৫টি অর্ডার আইডির বিপরীতে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ শপকে পরিশোধ করা হয়েছে এবং ৬৬১টি অর্ডার আইডির মোট ৬৫.৯৯ লাখ টাকা গ্রাহককে রিফান্ড করা হয়েছে মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, এসএসএল কমার্স কর্তৃক ৩ লাখ ৪ হাজার ৫২৫টি অর্ডারের বিপরীতে ৯০০ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ শপকে পরিশোধ করা হলেও উক্ত অর্ডারের পণ্য গ্রাহক বা ভোক্তাদেরকে প্রতিষ্ঠানটি সরবরাহ করেছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বর্তমানে SOFTWARE SHOP LTD এর কাছে ই-অরেঞ্জ.শপ এর গ্রাহক কর্তৃক পরিশোধিত মোট ১০ হাজার ১৮৭টি অর্ডার আইডির বিপরীতে প্রায় ৩৪.৬২ কোটি টাকা অনিষ্পন্ন/অপরিশোধিত অবস্থায় ESCROW হিসাবে জমা আছে। পেমেন্ট গেটওয়ে ছাড়াও গ্রাহকরা সরাসরি ই-অরেঞ্জ.শপ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যাংক হিসাবে ছোট ছোট অংকে নগদ জমা ও অনলাইন ট্রান্সফারের মাধ্যমে পণ্য ক্রয়ের অর্থ জমা করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে।
ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক হিসাবে জমাকৃত অর্থ থেকে বিভিন্ন মার্চেন্টকে সময়ে সময়ে মোট ৪৯৭.৭৯ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব মার্চেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে অল জোন-কে ১৮৮.৬৪ কোটি টাকা, বাজাজ কালেকশনকে ১২৬.৩৭ কোটি টাকা, বাবু টেলিকমকে ৮.৭৩ কোটি টাকা, টিভিএস অটো বাংলাদেশ লিমিটেডকে ৯.৫৩ কোটি টাকা, এনবিএস ডিস্ট্রিবিউশন-কে ১৮.১৭ কোটি টাকা, বাইক ভ্যালি ঢাকা-কে ২.৩৪ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডকে ১৮.৯ কোটি টাকা, এসিআই লজিস্টিকস সার্ভিসেস লি.-কে ৩০.৪১ কোটি টাকা, বাটারফ্লাই মার্কেটিং লিমিটেডকে ৫.৩৩ কোটি টাকা, গিয়ার এক্স বাংলাদেশ লি.-কে ১.৮৩ কোটি টাকা, নিলয় মটরস লি.-কে ১.৬৯ কোটি টাকা, আজিয়াটা ডিজিটাল সলিউশনস লি.-কে ০.৭২ কোটি টাকা, একেএস গ্লোবাল ট্রেডিং লি.-কে ১.৫৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ৩টি কম মূল্যে পণ্য বিক্রির নামে গ্রাহকের অর্ডার করা পণ্যের অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে এসব মার্চেন্টের কোনো যোগসাজশ রয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি, যা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করা আবশ্যক। মার্চেন্ট ছাড়া ই-অরেঞ্জ.শপ এর হিসাব থেকে আমদাদুল হক মিলন, মুনতাছির মামুন, মহসিন রেজা চৌধুরী, ফজলুর হক, মো. জুবায়ের শিকদার, মো. কামরান হাসান, মো. রনি, ফায়মা চৌধুরী অদিতি, মো. মামুন, আনোয়ার হোসেন মামুন কর্তৃক নগদে ২৫.৯৪ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে যার প্রকৃত সুবিধাভোগীকে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে চেক ক্লিয়ারিং ও নগদ উত্তোলনের মাধ্যমে হিসাবধারী সোনিয়া মেহজাবিন এর ভাই শেখ সোহেল রানা কর্তৃক মোট ২.২৩ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে, যা খুবই সন্দেহজনক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ এর প্রতিষ্ঠান রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল এর ব্যাংক হিসাবে ফান্ড ট্রান্সফার করে মোট ৯৭ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে।
সন্দেহভাজন সোনিয়া মেহজাবিন কর্তৃক দি সিটি ব্যাংক লি. এর ই-অরেঞ্জ.শপ এর হিসাব থেকে তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে অর্থ স্থানান্তর ও নগদে মোট ৩.১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করেন এবং ফান্ড ট্রান্সফার করে আইপিডিসি ফাইন্যান্স লি. এর হিসাবে ২.৫০ কোটি টাকা স্থানান্তর করে ব্যক্তি নামে স্থায়ী আমানত হিসাব খোলেন। সোনিয়া মেহজাবিন এর স্বামী মো. মাসুকুর রহমান অরেঞ্জ বাংলাদেশ এর হিসাব থেকে দুই দফায় মোট ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। অর্থাৎ সোনিয়া মেহজাবিন, তার ভাই সোহেল রানা, মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ ও মো. মাসুকুর রহমান কর্তৃক ই-অরেঞ্জ.শপ এর হিসাব থেকে মোট নগদ ও ফান্ড ট্রান্সফার করে মোট ৯.০৬ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে।
এছাড়া সোনিয়া মেহজাবিন জমি ও অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ের উদ্দেশ্যে আফরোজা খাতুন, ডা. মো. জাহিদ হোসেন ও সাবনাজ মেহজাবিন এবং সাউথ ব্রিজ হাউজিং সোসাইটিকে মোট ৯.৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেন।
প্রতিবেদনের সার্বিক পর্যালোচনা অংশে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ.শপ, অরেঞ্জ বাংলাদেশ ও রেড অরেঞ্জ ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক কমমূল্যে গ্রাহকদের পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন লোভনীয় অফারে প্রলুব্ধ করে বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের কাছ থেকে অর্ডারের মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক হিসাবে জমা করেছেন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পরে জমা করা অর্থ থেকে বিভিন্ন মার্চেন্টকে পরিশোধ করার পাশাপাশি সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই শেখ সোহেল রানা ও চাচা মোহাম্মদ জায়েদুল ফিরোজ কর্তৃক নগদে উত্তোলন ও ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর এবং নিজ নামে স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করার জন্য মোট ১৮.৫৬ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ এর হিসাব থেকে স্থানান্তর/উত্তোলন করেন। গ্রাহকদের অগ্রীম মূল্য পরিশোধিত অর্ডারের কাঙ্ক্ষিত পণ্য সরবরাহ না করে সন্দেহভাজনরা উল্লিখিত অর্থ তাদের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর, নগদে উত্তোলন ও ব্যক্তিগত স্থায়ী সম্পদ ক্রয় করেছেন মর্মে পরিলক্ষিত হয়েছে যা প্রতারণার শামিল।
উল্লেখ্য, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২(শ)(৫) ধারা অনুসারে প্রতারণা সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে সংজ্ঞায়িত। কাজেই বর্ণিত অপরাধলব্ধ আয় আলোচ্য ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা, উত্তোলন, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে সন্দেহভাজন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে।
বিএফআইইউ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপের বিষয়ে বলা হয়েছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সব হিসাবের সব তথ্য তদন্তের স্বার্থে ২৩/০৬/২০২১ তারিখে সিআইডিতে সরবরাহ করা হয়েছে। ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত সব হিসাবে প্রতারণা থেকে উদ্ভূত অর্থ জমা হয়ে থাকতে পারে মর্মে সন্দেহ করে সিআইডির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে হিসাবগুলোর লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ২৩(১)(গ) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে গত ২৫/০৮/২০২১ তারিখে স্থগিত করা হয়। পরে ওই স্থগিতাদেশ ৩য় দফায় বর্ধিত করা হয়। বর্তমানে ই-অরেঞ্জ.শপ ও এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত মোট ৮টি হিসাব আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
এর আগে গত ৭ এপ্রিল ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এনে ভুক্তভোগীদের মধ্যে বণ্টন করার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। এছাড়া বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদন চাওয়া হয়।
এমএইচডি/জেডএস