বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা : ঘাতকদের ফাঁসি কবে দেখবে দেশ
বর্বরোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার ১৮ বছর পূর্ণ হচ্ছে রোববার। ২০০৪ সালের এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৫ বছর আগে বিচারিক আদালত রায় দিয়েছেন। রায়ে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
নিয়মানুযায়ী রায়ের পরপরই ফাঁসির আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর অপরদিকে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামিরা।
কিন্তু উচ্চ আদালতে আলোচিত এ মামলার আপিল শুনানি এখনো শুরু হয়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্স এখনো ঝুলে আছে। আপিল নিষ্পত্তি না হওয়ায় সরকার রায়ও কার্যকর করতে পারছে না। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর দেখতে আরও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে দেশবাসীকে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারের অপেক্ষায় আছে। এরইমধ্যে মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। তার কারণ হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট হামলার মাধ্যমে রাষ্ট্রের একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। মামলাটি শুনানির জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দরখাস্ত করেছি। প্রধান বিচারপতি একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন।
তিনি বলেন, ডেথ রেফারেন্স হিসেবে যে মামলাগুলো হাইকোর্টে আসে, সেগুলো কিন্তু প্রধান বিচারপতি নির্দিষ্ট করে হাইকোর্টের বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। পরে সেই বেঞ্চেই শুনানি হয়। সে কারণে আমরা প্রধান বিচারপতির কাছে একটি দরখাস্ত করেছি এই মামলাটি শুনানির জন্য, যেন একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন। আশা করছি আগামী অক্টোবর মাসে মামলাটি শুনানির জন্য একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন তিনি। আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা এখন হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা আসামিপক্ষ থেকে শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি। কার্যতালিকায় এলে আমরা শুনানি করব। আমরা মনে করি, মুফতি হান্নানের মাধ্যমে এই মামলায় বড় নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। এই মামলায় তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আজ্ঞাবহ তদন্ত কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদেরকে সম্পৃক্ত করা হয়। রাজনৈতিকভাবে হয়রানি করার জন্যই তাদের এ মামলায় চার্জশিটভুক্ত করা হয়েছে। উচ্চ আদালতে আপিল শুনানিতে আমরা এসব বিষয় তুলে ধরব।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও হত্যা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ফাঁসি এবং বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামি
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, জঙ্গি নেতা মাওলানা তাজউদ্দীন, মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, মাওলানা আবু সাইদ, মুফতি মঈনউদ্দিন শেখ ওরফে আবু জান্দাল, হাফেজ আবু তাহের, মো. ইউসুফ ভাট ওরফে মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক, মফিজুর রহমান ওরফে মহিবুল্লাহ, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হোসাইন আহমেদ তামিম, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ও মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন।
যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১৯ আসামি
শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফের আবু ওমর, আবু হোমাইরা ওরফে পীরসাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুজন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মহিবুল মোত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন (পলাতক), আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন (পলাতক), মো. খলিল (পলাতক), জাহাঙ্গীর আলম বদর ওরফে ওস্তাদ জাহাঙ্গীর (পলাতক), মো. ইকবাল (পলাতক), লিটন ওরফে মাওলানা লিটন (পলাতক), তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া (পলাতক), হারিছ চৌধুরী (পলাতক), কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (পলাতক), মুফতি শফিকুর রহমান (পলাতক), মুফতি আবদুল হাই (পলাতক) এবং রাতুল আহম্মেদ বাবু ওরফে বাবু ওরফে রাতুল বাবু (পলাতক)।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পাতার নথি ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। পরে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের শুনানির জন্য মামলার পেপারবুক তৈরির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সেই আদেশের ধারাবাহিকতায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সাড়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
আসামিদের মধ্যে ২২ জন খালাস চেয়ে আপিল করেছেন। অপরদিকে ১২ জন আসামির জেল আপিল দায়ের হয়েছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা-বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতা-কর্মী। তাদের অনেকে আজও শরীরে গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছেন। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন।
এমএইচডি/জেডএস