কানাডার ‘লেক্স ফলকন অ্যাওয়ার্ড’ জয়ী ব্যারিস্টার ফারজানা শিলা
ব্যারিস্টার ফারজানা শিলা। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী। স্বামী ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমনও আইনজীবী। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ছোটবেলা থেকে সব ক্ষেত্রে মেধার স্বাক্ষর রাখা ফারজানা বিচারক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আইনে ভর্তি হন। ব্যারিস্টারি পড়তে পাড়ি জমান লন্ডনে। নর্দাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বার এট ল’ ডিগ্রি অর্জন করেন। লন্ডন কলেজ অব ল’ থেকে হিউম্যান রিসোর্সে লাভ করেন পিএইচডি ডিগ্রি।
২০০৩ সালে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন আইনপেশা। ব্যারিস্টার দম্পতি প্রতিষ্ঠা করেন আইনি সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ল’ বেল। ১৭ বছর ধরে আইনপেশায় থাকা ফারজানা নিজের প্রতিষ্ঠিত নান্দনিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের মাধ্যমে অসহায় শিশুদের পুর্নবাসন, শিক্ষা নিশ্চিত ও নারীদের ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছেন। নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী হিসেবে কানাডার লেক্স ফলকন অ্যাওয়ার্ড-২০২২ লাভ করেছেন। ভবিষ্যতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এ নারী আইনজীবী।
আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড অর্জন, নিজের স্বপ্ন, ভবিষ্যত পরিকল্পনাসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।
পারিবারিক পরিচয়-পড়ালেখা
আমার জন্ম ঢাকার ওয়ারীতে। ওয়ারীতে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা দেবীদ্বার। বাবা শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী ছিলেন। বাবা কুমিল্লাতে অনেক মসজিদ, স্কুল, কলেজ এনজিও অনেক কিছু করে গেছেন। মাও সভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও হলিক্রস কলেজ থেকে এইচ এস সি পাস করি। তারপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে ভুঁইয়া একাডেমিতে ভর্তি আইনে হই। ইংল্যান্ডে নর্দাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে বিপিটিসি কোর্স শেষ করি। লিংকন্স ইন থেকে কল টু দ্যা বার নেই। পাশাপাশি লন্ডন কলেজ অব ল থেকে হিউম্যান রিসোর্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করি।
আমরা দুই ভাই দুই বোন। বড় ভাই ব্যবসায়ী। আরেক ভাই আমেরিকাতে পড়ালেখা করে সেখানে সেটেলড। তারপর আমি। ছোট বোন বিবিএ-এমবিএ করে আপাতত হাউজ ওয়াইফ। আমাদের একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
আইন কেন পড়লেন ?
ছোট বেলা থেকে শখ ছিল বিচারক হওয়ার। একদম পিচ্চি বয়স থেকে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করতো, তুমি কি হবে আমি বলতাম আমি বিচারক হব। আর মানুষের জন্য অনেক ছোট বেলা থেকে আমার টান ছিল। এ কারণে বিচারক বা ল’ইয়ার হওয়ার কথা ছোট বেলা থেকে বলতাম। আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সচিব, বড় কর্মকর্তা হই। কিন্তু কখনই আমার চাকরি করার কোনো ইচ্ছে ছিল না। মনে হয়েছিল আইন পড়লে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে পারব। আইনটা কিন্তু সবার জন্য। ধনী-গরিব সবার জন্য আইন প্রয়োজন আছে।
আইন পেশায় অভিজ্ঞতা নিয়ে বলুন
লিগ্যাল প্রফেশনে তো আমার ১৭ বছর হয়ে গেছে। আমি কোরিয়া-চায়নার অনেক কোম্পানির লিগ্যাল এডভাইজার ছিলাম। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এটুওয়াই প্রজেক্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছি। পাওয়ার গ্রিডের আমি এডভাইজার ছিলাম। বর্তমানে কোরিয়ান কোম্পানি হাইসং, একটি চীনা কোম্পানির লিগ্যাল এডভাইজার হিসেবে আছি। এছাড়া বিসিআইসি, সিটি করপোরেশন, অগ্রণী ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের প্যানেল ল‘ইয়ার হিসেবে কাজ করছি। কোম্পানি ম্যাটার, রিট ম্যাটার এ সংক্রান্ত মামলা বেশি করি। এছাড়া জনস্বার্থেও মামলা করেছি। বাংলাদেশ ও প্রধানমন্ত্রী নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ পরিবেশন করায় আল জাজিরার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। যার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সেই প্রতিবেদন রিমুভ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সংখ্যা নিয়ে মিথ্যাচার করার কারণে ডেভিড বার্গমানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম। এ মামলা করার কারণে বার্গম্যান একদিনের শাস্তি পেয়েছিলেন।
আমাদের চেম্বারের নাম ল’বেল ব্যারিস্টার অ্যান্ড অ্যাডভোকেটস। আমরা স্বামী ও স্ত্রী এটার মালিক।
বিয়ে ও পারিবারিক জীবন
ব্যারিস্টার এম এনামুল কবির ইমন ও আমার পছন্দের বিয়ে। এলএলবি অনার্স শেষ করে ৯৯ সালের নভেম্বরে বিয়ে করি। তারপর লন্ডন চলে যাই।
স্বামী ব্যারিস্টার ইমন সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের দুইবার প্রশাসক ছিলেন। এখন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। যুবলীগের প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও সুনামগঞ্জ যুবলীগের কনভেনর ছিলেন। লন্ডনে পড়াশুনার সময় ইউকে তিনি যুবলীগের আহ্বায়ক ছিলেন। আমাদের একমাত্র সন্তান রাভিপ্রিয়া কবীর গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে।
আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার গল্পটা বলুন
কানাডিয়ান ও ইন্ডিয়া বেইজড সংস্থা লেট ওয়ার্ল্ড টকস। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এ প্রজন্মের কিছু প্রতিশ্রতিশীল আইনজীবীকে সিলেক্ট করলো যারা কোভিডের সময় তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে বেশি কাজ করেছে। যারা অনলাইনে কাজ করেছে, আইন পেশায় যাদের ১০ বছরের ওপরে যাদের প্র্যাকটিস। জুম মিটিং করে লেট ওয়ার্ল্ড টকস কর্তৃপক্ষ জানালো আপনাকে আমরা অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত করেছি।
গত ২৩, ২৪ মার্চ দুদিনের কনফারেন্স শেষে দু্বাইয়ের হোটেল ক্রাউন প্লাজাতে লেট ওয়ার্ল্ড টকসের অ্যাডভাইজারি বোর্ডের প্রধান প্রফেসর চার্লস ব্রাউন আমার হাতে লেক্স ফলকন অ্যাওয়ার্ড-২০২২ তুলে দেন। ওইখানে আমি নিজের দেশের কথা বলেছি। কনফারেন্সে বর্তমান বিশ্বের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে এমন আইন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেমন ডাটা প্রাইভেসি এবং কমপ্লায়েন্স ল’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ফেসবুক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কনফারেন্সে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, কানাডা, চীন, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ ২০টি দেশ থেকে এক হাজার ডেলিগেট অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মধ্যে ১০০ জনকে জনকে এ অ্যাওয়ার্ড তুলে দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই
আমার খুবই ভাল লেগেছে। আমি খুবই এক্সাইটেড যে বিশ্বের ২০টি দেশের প্রতিনিধিদের মাঝখান থেকে আমি অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেছি এবং আমার দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি। এটা আমার কাছে অনেক বড় অর্জন। এ অ্যাওয়ার্ড অর্জন আমার দায়িত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এর মাধ্যমে আমি নিজেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে পেরেছি। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমাকে জবের অফার দিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ড থেকে আমাকে অফার করেছে লিগ্যাল এডভাইজর হিসেবে জয়েন করার জন্য। মেয়ে হিসেবে আরও বেশি প্রাউড ফিল করেছি। বাংলাদেশের একজন মেয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পেলাম এবং দুবাইতে গিয়ে গ্রহণ করলাম আইনজীবী হিসেবে অনেক বড় অর্জন বলে মনে করি।
সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা
আমার এ পর্যায়ে আসার পেছনে আমার স্বামীর অবদান তো একদম হান্ডেট পারসেন্ট। ওর সহযোগিতা ছাড়া এ পর্যায়ে আসা একেবারে অসম্ভব ছিল। সব সময় ইমন আমাকে উৎসাহ উদ্দীপনা ও সাহস দিয়ে থাকে। যেকোন কিছু আমরা দুজন মিলে করি। কোনো লিগ্যাল ওয়ার্ক হোক বা ফাউন্ডেশনের কাজ হোক যেকোন কিছুই আমরা মিলে করার চেষ্টা করি।
সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ সম্পর্কে জানতে চাই
আমার নান্দনিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ নামে একটা সংগঠন আছে। এটার আমি চেয়ারম্যান। এটার মাধ্যমে আমি সুনামগঞ্জে একটি স্কুল পরিচালনা করি। প্রায় ২৫০ শিক্ষার্থী সেখানে পড়ে। আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে এ ফাউন্ডেশন পরিচালনা করি। এ সংগঠনের মাধ্যমে আমরা গরীব-অসহায় মানুষকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে থাকি। সব সময় নিজের জন্য চিন্তা করি না। মানুষের জন্য বড় পরিসরে কাজ করতে চাই। মনে করি আমার বাচ্চা পড়াশুনা করবে, ওরাও পড়াশুনা করুক। সমাজের অসহায় মানুষদেরও অধিকার আছে আমাদের প্রতি। টাকা নাই দেখে কি ওরা পড়াশুনা করতে পারবে না। এটা আমি কখনও মেনে নিতে পারি না। পড়াশুনা যেন সবাই করতে পারে। একটা শিক্ষিত জাতি যেন পায় এটা আমরা সব সময় চেষ্টা করে যাব।
ফাউন্ডেশন থেকে নারীদের অনেক হেল্প করি। আমরা সুনামগঞ্জের পলিটিকসে ইনভলব। সো, সুনামগঞ্জ থেকে বেশি খবর পাওয়া যায়। কয়েকদিন আগেও সুনামগঞ্জে একজন নারী ধর্ষণের স্বীকার হন। পুলিশ মামলা নিচ্ছিল না। আমরা মামলা নেওয়ানোর চেষ্টা করেছি। আমি নিজে কোর্টে মামলা নিয়ে গেছি। আমি সব সময় সুনামগঞ্জের নারীদের খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি। একইসঙ্গে নারীদের আইনি সহায়তা দিতেও চেষ্টা করি। আমার স্কুলের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেই কীভাবে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। ফাউন্ডেশন থেকে নারীদের স্বাবলম্বী করার জন্য বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করি। আমরা নারীদের শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম করে গড়ে তোলার জন্যও কাজ করছি।
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য মেসেজ
নারীরা পারে না একথা মানতে আমি নারাজ। আমাদের কেউ আটকে রাখবে এটা ঠিক না। এখন মেয়েদের অনেক পড়াশোনা ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ আছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। নারীরা পড়াশোনা করে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাবে এবং কোনো পিছুটান রাখবে না। কারণ আমাদের পারতেই হবে। ছেলেদের সঙ্গে তুলনা করব না। আমি মানুষ। আমি পারব। প্রত্যেক নারীকে একথা মনে রাখতে হবে।
স্বপ্ন-ভবিষ্যত পরিকল্পনা
আমি আগে ভাবতাম ল’ মিনিস্টার হবো। কিন্তু এখন আর ইচ্ছে হয় না। এখন মনে হয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া উচিত। কারণ আমাদের দেশে অনেক আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। আমি যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হই তাহলে কিন্তু অপরাধ দমন করতে পারব। সব অন্যায় রোধ করতে পারব। দরকার এখন অপরাধটাকে রোধ করা। শাস্তি থেকে দরকার অপরাধ কমিয়ে আনা। মানব পাচার কেন হয়, শিশুরা কেন ধর্ষিত হয়। নারী শিশু নির্যাতন কেন এত বৃদ্ধি পাবে। আমার মনে হয় শাস্তি থেকে বেশি প্রয়োজন অপরাধ রোধ করা। এ কারণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখি।
এমএইচডি/এসএম