প্রশংসায় ভাসছেন ড. তাহেরের আইনজীবী কন্যা
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে অ্যাডভোকেট সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদের অশ্রুসিক্ত ছবি। ছবি শেয়ার করে তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ নেটিজেনরা। সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ ১৬ বছর আগে খুন হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদের কন্যা।
বাবা হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে তিনি ১৬ বছর ধরে ছায়ার মতো লেগে ছিলেন। মামলা দ্রুত শেষ করতে তিনি রাষ্ট্রপক্ষের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রক্ষা করেছেন; গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্য সরবরাহ করেছেন। অবশেষে সর্বোচ্চ আদালত থেকে খুনিদের শাস্তির রায় নিশ্চিত করে ঘরে ফিরেছেন। গত ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগের রায়ের পর গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন সেগুফতা ও তার মা সুলতানা আহমেদ। সে সময় সেগুফতার চোখ বেয়ে ঝরছিল আনন্দঅশ্রু। সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে।
জাহিদ হাসান নামে এক সাংবাদিক সেগুফতার অশ্রুসিক্ত ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে লিখেছেন ‘ছেলে বা মেয়ে বিষয় নয়; শিক্ষিত, যোগ্য, সাহসী সন্তান প্রয়োজন।’ তিনি ওই পোস্টে লেখেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহেরকে খুন করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। তখন তার মেয়ে সেগুফ্তা তাবাসসুম আহমেদ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়েন। তার শিক্ষক বাবাই তাকে আইন বিষয়ে ভর্তি করেন। বাবা হত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্যই আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে আইনি পেশায় আসেন তাবাসসুম। বাবা হয়ত সেদিন চিন্তাও করেননি, তার কন্যারই আইনি লড়াই করতে হবে বাবা হত্যার বিচার নিশ্চিতে। বাবার হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে মাকে সঙ্গে নিয়ে এক কন্যার ধৈর্য ও লড়াই সত্যি প্রশংসার দাবিদার।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী নিলু ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘বাবা হত্যার বিচারের সঠিক রায় পেতে কন্যা সেগুফতা তাবাসসুমের দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্লান্তিহীন লড়াই বাংলাদেশের ইতিহাসে অনন্য নজির হয়ে থাকবে। বাবা হত্যার বিচার পেতে কতটুকু দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হলে দীর্ঘদিনের আইনি জটিলতা ডিঙিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, তা করে দেখালেন সাহসী ও দৃঢ়চেতা তাবাসসুম। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ।’
শাইনী কবির নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী সেগুফতার অশ্রুসিক্ত ছবি শেয়ার করে লিখেছেন, ‘স্যালুট! বাপ কা বেটি! রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত অধ্যাপক তাহের হত্যাকাণ্ডে দীর্ঘ ১৬ বছরের আইনি লড়াই শেষে আইনজীবী সেগুফতা তাবাসসুম তার বাবা হত্যার বিচারের চূড়ান্ত রায় পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে। তার দীর্ঘদিনের আইনি লড়াই সার্থক। তাই রায়ের পর মাকে নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে এসে কান্না লুকিয়ে রাখতে পারেননি তিনি। তার এই কান্নার মধ্যে যেমন আছে চাপা কষ্ট, তেমনি আছে স্বপ্ন পূরণের আনন্দ।’
এছাড়া শত শত ফেসবুক ব্যবহারকারী মায়ের সঙ্গে তার অশ্রুসিক্ত ছবি শেয়ার করে সেগুফতার ১৬ বছরের লড়াইকে স্যালুট জানিয়েছেন।
সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাবা আমাকে আইন বিষয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল আইনের শিক্ষক হবো। কিন্তু বাবাকে হত্যা করার পর জীবনের লক্ষ্য পাল্টে যায়। তখন সিদ্ধান্ত নিই আমি প্র্যাকটিসিং ল’ইয়ার হবো। আইনজীবী হয়ে বাবার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করব। রাজশাহীর আদালতে ২০০৮ সালে যখন এ হত্যা মামলার রায় হয় তখনো আমি আইনের ছাত্রী। তবে ২০১৩ সালে যখন হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সের রায় হয় তখন আমি আইনজীবী।’
‘বিচারিক আদালতে রায় হওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ আদালতে রায় হওয়া পর্যন্ত আমি এ মামলার বিচারে ছায়ার মতো লেগে ছিলাম। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। উচ্চ আদালতে মামলা দ্রুত শেষ করতে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে কত যে দৌড়াদৌড়ি করেছি তার হিসাব নেই। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগে দ্রুত বিচারের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তারপরও ধন্যবাদ জানাই রাষ্ট্রপক্ষকে। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়কে। ধন্যবাদ জানাই আমার সিনিয়র অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথিকে। তিনি আমাকে সব সময় সাহস দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিচার শেষ করতে পেরেছি। আপিল বিভাগ আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। সেখানে বিচার শুরুর পরে আর ভোগান্তি পোহাতে হয়নি। এজন্য আমি সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
তাহের হত্যা মামলার আপিল বিভাগের রায়
গত ৫ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের হত্যা মামলায় একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনের ফাঁসি বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে ড. তাহেরের বাসার কেয়ারটেকার মো. জাহাঙ্গীর আলমের মৃত্যুদণ্ড এবং অন্য দুই আসামির যাবজ্জীবন দণ্ডও বহাল রাখা হয়।
যাবজ্জীবন সাজা বহাল থাকা দুজন হলেন নাজমুল আলম ও আব্দুস সালাম। প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৬ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল অবন্তী নূরুল ও মোহাম্মদ সাইফুল আলম। আসামিপক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী।
রায় ঘোষণার সময় ড. তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ, ছেলে সানজিদ আলভী আহমেদ, মেয়ে অ্যাডভোকেট সেগুফতা আহমেদ, তাদের পরিবারের আইনজীবী অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি ও শাকিলা রওশন উপস্থিত ছিলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ওইদিন বলেন, ‘ড. তাহের হত্যা ছিল ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। আজকের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ রায়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলো। এর মাধ্যমে অন্যদের কাছেও বার্তা যাবে যে, এ ধরনের জঘন্য অপরাধীদের ছাড় নেই।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী বলেন, ‘আসামিদের পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
ড. এস তাহেরের স্ত্রী সুলতানা আহমেদ ওইদিন রায়ের পর বলেন, ‘১৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছি। আপিল বিভাগ আজ আসামিদের সাজা বহাল রেখেছেন। আমরা ন্যায়বিচার পেয়েছি। দ্রুত এ রায় কার্যকরের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করছি। রায় কার্যকর হলে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হবো।’
অধ্যাপক ড. তাহের হত্যা মামলায় ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুতবিচার আদালত চারজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং দুজনকে বেকসুর খালাস দেন। পরে আসামিরা এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন।
২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল হাইকোর্ট দুই আসামির ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন এবং অন্য দুই আসামির দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধেও আসামিরা আপিল করেন।
৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলেন।
২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকার ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় নৃশংসভাবে হত্যার শিকার অধ্যাপক ড. তাহেরের মরদেহ। এর দুদিন পর ওই বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি নিহতের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এমএইচডি/এসএম/জেএস