সুশান্ত পালের জীবনের গল্প
সুশান্ত পাল। জনপ্রিয় ক্যারিয়ার বিষয়ক বক্তা। ৩০তম বিসিএসে হয়েছেন দেশ সেরা। বর্তমানে বাংলাদেশ কাস্টমসের উপ-কমিশনার হিসেবে কর্মরত আছেন। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন জীবনের নানা অভিজ্ঞতা।
ঢাকা পোস্ট : আপনাকে নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। জানতেও চাই অনেক কিছু। তবে শুরু হোক, আপনার ছোটবেলার গল্প দিয়ে...
সুশান্ত পাল : আমার জন্ম চট্টগ্রামে। বাবা আইনজীবী, মা স্কুল-শিক্ষিকা। বেশ কড়া শাসনে বড় হয়েছি। বই পড়ার নেশা বাবা-মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। স্কুল-কলেজের রেজাল্টও ছিল প্রত্যাশা অনুযায়ী। বিশ্ববিদ্যালয় ওঠার আগ পর্যন্ত দশটা ছাত্রের মতোই গতানুগতিক ধাঁচের ছিলাম। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে গল্পের বই পড়তাম। টুকটাক ছড়া-কবিতাও লিখতাম। বাবা-মা জোর দিতেন বেসিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ার জন্য। ফলে কিছুই বাদ দিয়ে পড়িনি। আমার একটাই মন্ত্র, ‘নো শর্টকাট’!
ঢাকা পোস্ট : বিসিএস দেওয়ার চিন্তাভাবনা কেন হলো? প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কীভাবে?
সুশান্ত পাল : ব্যবসা করতাম, নিজের কোচিং সেন্টার ছিল। বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে অনেক হতাশা ছিল, চরম পর্যায়ের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতাম। এমনকি আত্মহত্যাও করতে গিয়েছিলাম। অনার্স কমপ্লিট করার প্ল্যান ছিল না কখনোই। এক বন্ধুর কথায় রাজি হয়ে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। তখন অনার্সের সার্টিফিকেট তোলার জন্যই ফাইনাল ইয়ারের থিসিস কমপ্লিট করি। জীবনে ওটাই ছিল আমার প্রথম ও শেষ চাকরির পরীক্ষা দেওয়া।
যদিও বিসিএস নিয়ে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। সবার কাছে শুনেছিলাম এই পরীক্ষাটা বেশ কঠিন। ভয় পেয়েছিলাম। ফলে প্রতিদিন ১৫-১৬ ঘণ্টা পড়তাম। কোচিং, ব্যবসা সবকিছু বন্ধ করে সারা দিন-রাত পড়তাম। তবে সবসময়ই নিজস্ব কিছু টেকনিক অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিয়েছি। যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভালো করার মূলমন্ত্র, যেটা পড়ব সেটা বুঝে পড়ব। অন্যদের অন্ধ অনুকরণ না করে নিজের পড়ার ধরনটা নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে। তবেই সাফল্য আসবে।
ঢাকা পোস্ট : এভাবেই ৩০ বিসিএসে প্রথম হয়ে গেলেন! খবরটা শুনে নিজের বিশ্বাস হয়েছিল?
সুশান্ত পাল : মাত্র দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে জীবন বদলে যায়। চাকরি পেতে কেমন লাগে, সেটাই তো জানতাম না। যে চাকরিটা পেয়ে গেলে জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যাবে বলে ভাবতাম, সেই চাকরিটা পেলে কী করতে হয়, আমার জানা ছিল না। তখন শুধু নিজেকে ওই সময়ের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়েছে। মাকে খবরটা দেওয়ার পর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। বুঝতে পারছিলাম, এই কান্নার ভিন্ন অর্থ আছে। বাবাকে খবরটা ফোনে জানিয়েছিলাম। মা-বাবার চোখে আমার জন্য যে হাসিটা দেখেছি, সে দৃশ্য একজন সন্তানের জন্য বড় আনন্দের।
বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির সব কষ্ট মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গিয়েছিলাম। পৃথিবীর সব নিষ্ঠুর মানুষকে ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে করছিল। জীবনটাকে মনে হতে লাগল নিশ্চিন্ত, নির্ভার আর খুব খুব সুন্দর। আমাকে মানুষ হিসেবেই গণ্য করত না, এমন লোকজনও ফোনে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। সেদিন একটা বিষয় উপলব্ধি করেছিলাম, আইডেন্টিটি ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট দ্যান একজিস্টেন্স।
২০১১ সালের সে জন্মদিন ছিল আমার একমাত্র জন্মদিন, যে জন্মদিনে আমাকে কেউ কোনো উপহার দেয়নি। অথচ সেদিনের উপহারটি আমার আগের ২৬টা জন্মদিনের সব উপহারকেই ম্লান করে দিয়েছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো সরাসরি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে জন্মদিনের উপহার পেলাম। সে উপহার তো আর ছোট হতে পারে না। স্রষ্টা আসলেই কাউকে চিরদিন অসম্মানিত করে রাখেন না। তাঁর দেওয়া উপহার অনেক বড়। সেটা পাওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমও।
ঢাকা পেস্ট : বর্তমানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নিয়ে ব্যাপক উদ্দীপনা দেখা যায়। এমনকি কেউ কেউ বিসিএসকে জীবনের মুখ্য বিষয় ভাবে। এমনটা কি হওয়া উচিত?
সুশান্ত পাল : উচিত অনুচিত বলে কিছু নেই। যা হচ্ছে, তা তো হচ্ছেই! তবে কেন হচ্ছে, তা নিয়ে বলা যেতে পারে। একটি দেশের চাকরি প্রত্যাশীরা কোন দিকে ঝুঁকবে বা ঝুঁকবে না, তা নিয়ে নীতিনির্ধারক মহলে আলাপ চলতে পারে। যার স্বপ্ন যেদিকে, সে ওই পথেই যাবে। জীবনে ভালো কিছু করতে হবে, মা-বাবা ও প্রিয় মানুষগুলোকে খুশি করতে হবে, এমন ইচ্ছে তো সবারই থাকে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গিয়ে মানুষ মূলত তিনটি বিষয়ের উপর জোর দেয়- ইচ্ছে, সুযোগ ও সামর্থ্য। এই তিনের সমন্বয় করতে পারলে ভালো একটা ক্যারিয়ার গঠন করা সম্ভব। পারিবারিক ও সামাজিক প্রেরণা কিংবা প্রেষণা, তার সঙ্গে নিজের সিদ্ধান্ত মিলেই মানুষ ক্যারিয়ার নির্বাচন করে। সেটা ব্যবসা, চাকরি যেকোনো কিছুই হতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বর্তমানে ইউটিউব ও ফেসবুকে আপনি বেশ সরব। এ বিষয়ে জানতে চাই..
সুশান্ত পাল : বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম না হলে এমনটা হতো বলে আমার মনে হয় না। মানুষ সফলদের গল্প শুনতে চায়। অবশ্য আরও দু-একটি বিষয় এখানে কাজ করেছে এবং করে। আমি সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে ‘ক্যারিয়ার আড্ডা’ শিরোনামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বক্তব্য দিয়েছি, কোভিড-পরবর্তী সময়ে অনলাইনেও একই শিরোনামে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সামনে এসে মাঝে মাঝে কথা বলি। এই কাজটি আমি করি সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে। বক্তব্যগুলো ইউটিউবে দেওয়া আছে। এ ছাড়া বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির কৌশল নিয়ে অনেক কথা বলেছি ও লিখেছি। সাহিত্য, দর্শন, মনস্তত্ত্ব নিয়েও আমার অনেক লেখা আছে, যা আমার ওয়েবসাইট থেকে পড়া যায়। এই তো!
ঢাকা পোস্ট : আপনার সফলতার পেছনে নিশ্চয়ই ব্যর্থতাও লুকিয়ে আছে। এমন কিছু ব্যর্থতার গল্প শুনতে চাই।
সুশান্ত পাল : আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম। বিষের পেয়ালা হাতে নিয়ে প্রথমেই মনে হলো, এটা খেয়ে ফেললে সত্যি সত্যিই যদি মরে যাই! আচ্ছা, মরে যাওয়ার সময় কি খুব ব্যথা লাগে? এই যে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি, মরে যাওয়ার কষ্ট কি এর চাইতেও বেশি? এভাবে মরে যাওয়ার সময় কি চারপাশটা অন্ধকার হয়ে যায়? বেঁচে তো আছি অন্ধকারেই, ওতেই মরব?
আমার মৃত্যুর পরের দৃশ্যটা কী হতে পারে, সেটাও কল্পনায় আনার চেষ্টা করলাম। মা বিলাপ করে করে কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্ছা যাবে। বাবা কোর্ট ফেলে ছুটে আসবে। বাবাও অনেক কাঁদবে। মা-বাবা কাঁদলে শরীর ভেঙে পড়ে, ভীষণ অসুস্থ হয়ে যায়। আমার ছোট ভাই কিছুক্ষণ ভাববে কী করা উচিত, এরপর সেও হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করবে। আশেপাশে যারা থাকবে, ওরা কষ্টে না হলেও ওদের তিন জনকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করবে। কান্না মাত্রই সংক্রামক। সামনে বসে কেউ কাঁদলে তার সঙ্গে জয়েন করা একটা ভদ্রতা।
পরে ভাবলাম, যে জীবনটা আমার মায়ের দেওয়া, সেটাকে নিজ হাতে হত্যা করার অধিকার কি আমার আছে? নিজের জীবনের উপরে কারো একচ্ছত্র দাবি থাকে না। এসব ভেবে আমার কেমন জানি গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল, মন হালকা করার কান্না। কিন্তু কাঁদতে পারছিলাম না।
সুইসাইড করার নিয়ম হলো, এত চিন্তাভাবনা করা যাবে না, জাস্ট ডু ইট। মরে যাওয়া মানেই তো সব কিছু নাই হয়ে যাওয়া। মৃত মানুষের ভালো লাগা-খারাপ লাগা বলে তো আর কিছুই থাকে না। কে কাঁদল, কে হাসল, এ নিয়ে ভাববার কী আছে? তবুও ভাবনা হয়। বেঁচে থাকার অভ্যাস যার, মরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সে একটু ভাবতেই পারে। এতে দোষের কিছু নেই।
কিছুক্ষণ পরে ভাবনাটা মাথায় এল; আর দশজন উজ্জ্বল মানুষের মতো না হোক, অন্তত একজন অনুজ্জ্বল মানুষ হয়েও বেঁচে থেকে দেখিই না কী হয়!
ঢাকা পোস্ট : বিসিএস দিতে যারা আগ্রহী, তাদের জন্য কোনো পরামর্শ?
সুশান্ত পাল : আপনি যে চাকরিটা প্রায় ত্রিশ বছর করতে চাইছেন, সেটা পাওয়ার জন্য ছয় মাসের ঘুম কমিয়ে পড়াশোনা করতে পারবেন না, তা হয় না। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করুন, হয়তো আপনার জন্য এমন একটা জীবন অপেক্ষা করছে, যা আপনি ভাবতেও পারছেন না! সবসময় মাথায় রাখবেন, যতক্ষণ আপনার শরীরের শেষ রক্তবিন্দুটিও অবশিষ্ট আছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি কিছুতেই পরাজিত নন, যে যা-ই বলুক না কেন!
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সুশান্ত পাল : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ। অনেক অনেক শুভ কামনা।