তানভীরের অ্যামাজনে চাকরি পাওয়ার গল্প
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অনলাইন মার্কেট প্লেস অ্যামাজনের অস্ট্রেলিয়া শাখার প্রোডাক্ট পেমেন্ট ম্যানেজমেন্টের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। পড়াশোনা করেছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। পরবর্তীতে প্রোডাক্ট ও পেমেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল হিসেবে ক্যারিয়ার গড়েছেন। সম্প্রতি তার ক্যারিয়ারের নানা ঘটনা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে-
ঢাকা পোস্ট: অ্যামাজনে চাকরি পাওয়ার পেছনের গল্পটি বলুন।
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: আমি মূলত এমন একটি কর্মক্ষেত্র চেয়েছিলাম, যেটি আমাকে 'কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স' নিয়ে কাজ করার সর্বোচ্চ সুযোগ দেবে। পাশাপাশি থাকবে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভ্রমণ ও নানান মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ। আগে যে প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেছি সেখানে ছোট পরিসরে হলেও এসব সুযোগ ছিল, তবে সে তুলনায় অ্যামাজনের পরিধি ও ব্যাপ্তি অনেক বড়। জাপানের টোকিওতে একটি ই-কমার্স জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় অ্যামাজনে কাজের সুযোগ আসে। মনে হলও, এখানে আমি নিজেকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের পথচলায় অবদান রাখতে পারব। পরে আবেদন করি। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আমার চাকরি হয়। সে থেকে এ পর্যন্ত অ্যামাজনের সঙ্গে দারুণ সময় কাটিয়েছি। ২০১৯ সালে জাপান থেকে বদলি হয়ে আসি অ্যামাজন অস্ট্রেলিয়ায়।
ঢাকা পোস্ট: অ্যামাজনে নিয়োগ পেতে কী কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: বেশ কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে অ্যামাজনে চাকরিপ্রত্যাশীদের ইন্টারভিউ করা হয়। প্রথমে ফোন স্ক্রিনিং, পরে রিটেন এক্সারসাইজ-যেখানে নিজের 'আইডিয়া' নিয়ে লিখতে হয়, আর তারপর 'লুপ ইন্টারভিউয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। সেখানে অ্যামাজনের একাধিক কর্মকর্তা আলাদাভাবে ইন্টারভিউ নেন।
ঢাকা পোস্ট: অ্যামাজনের মতো নামীদামী প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য প্রার্থীর কোন ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: অ্যামাজনের কিছু নির্দিষ্ট 'লিডারশীপ প্রিন্সিপাল' রয়েছে, সে আলোকেই কর্মী খোঁজা হয়। যাচাই করা হয় প্রার্থীর নেতৃত্বের গুণাবলী। ওই প্রার্থী তার পূর্বের কর্মস্থলে কেমন ভূমিকা রেখেছেন, সেখানে তিনি কোন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেই বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করা হয়। আর ইন্টারভিউটি প্রশ্নোত্তর কেন্দ্রিক নয়, বরং অনেকটাই 'বোথ ওয়ে কনভারসেশন' এর মতো। বলা যেতে পারে, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করেই কোনও এক বিষয়ে কথাবার্তা চালিয়ে নেয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রার্থীর সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও মনস্তত্ত্ব যাচাই করা হয়।
ঢাকা পোস্ট: যারা অ্যামাজনে চাকরি করার স্বপ্ন দেখেন, তাদের জন্য পরামর্শ কী?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: আমাদের লক্ষ্য যাই থাকুক না কেন, নিজের 'ভিশন' ও 'অ্যাকশন' এর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে সমানভাবে। যেকোনো লক্ষ্য পুরণে তিনটি জিনিস খুব প্রয়োজন- উদ্দেশ্য, বিশ্বাস ও কর্ম। জানতে হবে, যেটি অর্জন করার কথা ভাবছি সেটি কেন আমি অর্জন করতে চাই। নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। ধাপে ধাপে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগোতে হবে। যদি অ্যামাজনে যোগদান করা আমার লক্ষ্য হয়, তবে ওই তিনটি বিষয়কে কাজে লাগিয়েই সফল হওয়া সম্ভব। শুধু অ্যামাজন নয়, যেকোনো লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে নিজের কাজের প্রতি সততা, ধৈর্য ও একাগ্রতাই সাফল্য এনে দিতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।
ঢাকা পোস্ট: বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের জন্য বিদেশে বড় ই-কমার্স কিংবা টেক কোম্পানিগুলোতে কাজের সুযোগ কেমন?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: এখনকার সময়ে সুযোগ অনেক বেড়েছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে; যেকোনো ব্যবসার ক্ষেত্রেই বৈশ্বিক ভাবে নানাবিধ সুযোগ তৈরি হচ্ছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে ভালোমানের অনেক প্রতিষ্ঠানই মানসম্পন্ন কর্মী নিয়োগ করছে বৈচিত্র্য অনুযায়ী। এছাড়া বাংলাদেশের তরুণরা কর্মক্ষেত্রে কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকক্ষেত্রেই নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণে সফল হচ্ছে, যেটি আমাদের সুনাম তৈরি করছে।
ঢাকা পোস্ট: অ্যামাজনের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে কর্মী নিয়োগের আগ্রহ কেমন বলে মনে করেন?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: যেমনটা বলছিলাম, বাংলাদেশের তরুণরা ভালো করছে। ভালো করার কারণে সুযোগও বাড়ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানেই আমাদের তরুণরা, কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ- যেমন ভারতের তরুণরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা অন্য যে কারোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তারা বিশ্বমানের, ফলে তাদেরকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় আলাদা করে 'দক্ষিণ এশিয়া'র ক্ষেত্রে আগ্রহ কতটা—সেটির উত্তর দেয়া কঠিন।
ঢাকা পোস্ট: অ্যামাজনের পূর্বে কোথায় কোথায় কাজ করেছেন?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টে আসার আগে আমি একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী ছিলাম। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে দেশে একটি বহুজাতিক সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরির মাধ্যমে ক্যারিয়ার শুরু করি। কিছুদিন কাজ করার পর তাদের মাধ্যমেই চলে যাই জাপানে। চাকরির পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাই। পরে পর্যায়ক্রমে চাকরি বদল করে জাপানের শীর্ষস্থানীয় কিছু প্রতিষ্ঠানেও কাজের সুযোগ হয়। এক পর্যায়ে সফটওয়্যার ডেভেলপার থেকে প্রোডাক্ট পেমেন্ট ম্যানেজমেন্টের বিষয়টিতে ঝুঁকে পড়ি। প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট হয়ে জেনারেল ম্যানেজমেন্ট, আর সবশেষে পেমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতে প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টে ক্যারিয়ার গড়ি। 'কাস্টমার এক্সপেরিয়েন্স' নিয়ে কাজের আগ্রহ তখন থেকেই। অ্যামাজনে যোগ দেবার আগে কাজ করি ই-কমার্স জায়ান্ট 'রাকুতেন'-এ, বিশ্বের বহুল ব্যবহৃত ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেঞ্জার ‘ভাইবার’ এই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন।
ঢাকা পোস্ট: একজন ক্যারিয়ার সচেতন ব্যক্তি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কী করা উচিত বলে মনে করেন?
সৈয়দ তানভীর মোনাওয়ার: শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলব, শুধু ক্যারিয়ার নয়, একজন মানুষ হিসেবে সবদিক দিয়েই সমানভাবে বেড়ে উঠতে হবে। ব্যক্তিত্বে, পেশাদারিত্বে, আধ্যাত্মিকতায়, এবং অর্থ-বিত্তে। কারণ, নিজের বিকাশ ঘটাতে পারলে তখনই কেবল অন্যের উপকার করা সম্ভব হবে, অবদান রাখা যাবে সমাজ তথা দেশ বা বিশ্বের কল্যাণে। সর্বোপরি, সচেতন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। সে লক্ষ্যে বই পড়া, সৃজনশীল কাজে নিজেকে জড়িত রাখা, ভালো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মেলামেশা, লেখালেখি, মেডিটেশনসহ সবকিছুর মিশেলে শৃঙ্খলিত অথচ ইতিবাচক জীবনযাপন তৈরি করলে জীবন সুন্দর হবে, আর সেটিই ভালো ক্যারিয়ার গড়ে দেবে।