শূকরের হৃৎপিণ্ড লাগানো সেই রোগীর ভয়ঙ্কর অতীত সামনে এলো ৩ দশক পর
অনেক ক্ষেত্রেই রোগীদের বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকদের সামনে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা ছাড়া উপায় থাকে না। সম্প্রতি তেমনই এক যুগান্তকারী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ঘটনা সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথমবারের মতো রোগীর শরীরে জেনেটিকালি পরিবর্তিত একটি শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই ঘটনা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী। তবে এটি একইসঙ্গে হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা রোগীর অতীত ইতিহাস প্রকাশ্যে এনেছে। কারণ যে ব্যক্তি ওই যুগান্তকারী অপারেশনে দ্বিতীয় জীবন পেয়েছেন তার অতীত ইতিহাস বেশ ভয়ঙ্কর ও সহিংস।
সপ্তাহখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনেটের শরীরে শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা হয়। বাল্টিমোরের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসকরা ৭ ঘণ্টা ধরে পরীক্ষামূলক এই সার্জারি সফলভাবে সম্পন্ন করেন।
অপারেশনের মাধ্যমে দ্বিতীয় জীবন পাওয়া ডেভিড বেনেট অতীতে আরেক ব্যক্তির ওপরে ছুরি নিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন। আর এতে করে ভুক্তভোগী সেই ব্যক্তিকে হতে হয়েছিল প্যারালাইজড। আর তাই এই ধরনের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে রোগীর অপরাধের ইতিহাসকে বিবেচনা করা উচিত কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে। শনিবার (১৫ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
বিবিসি’র রেডিও ৪-এর একটি অনুষ্ঠানে লেসলি শুমাকার ডাউনি নামক এক নারী অভিযোগ করেন, তিন দশকেরও বেশি সময় আগে তার ভাই অ্যাডওয়ার্ড শুমাকারের ওপর ছুরি নিয়ে হামলা করেছিলেন শূকরের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনে নতুন জীবন পাওয়া ডেভিড বেনেট। সেই হামলা ও আঘাতের কারণেই তার ভাই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং পরবর্তী ১৯ বছর সেই অবস্থায় কাটিয়ে একপর্যায়ে মারা যান।
আর তাই শূকরের হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে ৫৭ বছর বয়সী ডেভিড বেনেটের নতুন জীবন পাওয়াকে সারা বিশ্বের মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নয়ন বলে মনে করলেও সেটি আসলে চিকিৎসার অগ্রগতিকে কলঙ্কিত করেছে বলে মনে করেন লেসলি শুমাকার ডাউনি।
তার অভিযোগ, ১৯৮৮ সালে ডাউনির ছোট ভাই অ্যাডওয়ার্ড শুমাকারকে সাতবার ছুরিকাঘাত করেছিলেন ডেভিড বেনেট সিনিয়র। ওই হামলার পর অ্যাডওয়ার্ড শুমাকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং এ কারণে পরবর্তী ১৯ বছর তাকে হুইলচেয়ারেই কাটাতে হয়েছিল। এরপর ২০০৫ সালে অ্যাডওয়ার্ডের স্ট্রোক হয় এবং এর দুই বছর পর ২০০৭ সালে মারা যান তিনি।
বিবিসি বলছে, ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে অ্যাডওয়ার্ড শুমাকারকে ছুরিকাঘাত করেছিলেন ডেভিড বেনেট। ঘটনার দিন নিজের স্ত্রীকে অ্যাডওয়ার্ড শুমাকারের কোলে বসে থাকতে দেখেন বেনেট। এরপরই রাগান্বিত হয়ে টানা সাতবার ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটান তিনি। এসময় অ্যাডওয়ার্ডের বয়স ছিল ২২ বছর।
অবশ্য ভাইয়ের ওপর এমন হামলার পর ডেভিড বেনেটের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছিলেন লেসলি শুমাকার। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর শুমাকার ও তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে বেনেটকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু ডাউনির দাবি, তাদের পরিবার ক্ষতিপূরণের কোনো অর্থই পায়নি।
অন্যদিকে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি আদালত বেনেটকে ১০ বছরের কারাদণ্ডও দিয়েছিলেন। তবে ভালো আচরণের কারণে কারাদণ্ডের ছয় বছরের মাথায় কারাগার থেকে মুক্তি পান অভিযুক্ত বেনেট।
অ্যাডওয়ার্ডের বোন ডাউনি আরও জানিয়েছেন, বেনেটের হামলার কারণে তার ভাইকে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়েছে। তাদের পরিবারকে বছরের পর বছর ধরে এক বিধ্বংসী ট্রমার মধ্য দিয়ে দিন পার করতে হয়েছে।
আর এ কারণেই এতো কিছুর পর শূকরের হৃৎপিণ্ডের মাধ্যমে বেনেট সিনিয়র আবার নতুন করে জীবন যাপনের সুযোগ পাবেন, এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না শুমাকার। তার মতে, এটি একজন ‘যোগ্য প্রাপক’ পেলে ভালো হতো। বিশেষ করে, শুধু আমেরিকাতেই অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষার তালিকায় রয়েছেন ১ লাখ ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ। আর এই অপেক্ষায় থেকে মৃত্যু হয় প্রতিদিন ১৭ জনের।
চিকিৎসকরা অবশ্য বলছেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো রোগীর অপরাধের ইতিহাস বিবেচনায় নেওয়া উচিত নয়। এছাড়া চিকিৎসা ও চিকিৎসাসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রেও অপরাধের ইতিহাসকে বিবেচনা করা হয় না। এমনকি কেউ কারাবন্দি হলেও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
টিএম