মিয়ানমারের গহিন জঙ্গলে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিদ্রোহীরা
মিয়ানমারের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ কারেনের গহিন জঙ্গলে গোপন ক্যাম্পে জান্তাবিরোধী বিদ্রোহীরা সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। দেশটির সবচেয়ে পুরোনো সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) সদস্যরা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
কীভাবে দ্রুততার সঙ্গে রাইফেলে গুলি ভরে তা নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে হয় কিংবা হাতে বানানো বোমার খুঁটি-নাটি জ্ঞান থেকে শুরু করে যুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে তাদের।
কারেনের জঙ্গলসহ দেশজুড়ে এ রকম বেশকিছু গোপন ক্যাম্পে বর্তমানে চলছে ক্ষমতাসীন জান্তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী বেসামরিক জনগণের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি।
বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে সম্প্রতি কারেনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের কিছু বিরল ছবি ও ফুটেজ এসেছে। এসব ফুটেজে যেসব বেসামরিক তরুণ-তরুণীকে দেখা যাচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত নেইপিদো, ইয়াঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন শহরে চাকরি করতেন। পরতেন নাম করা ব্র্যান্ডের রঙিন জামাকাপড়।
কিন্তু সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থান সব বদলে দিয়েছে। ক্যাম্পে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আসা এই তরুণ-তরুণীরা অভ্যুত্থানের পর বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু যখন তারা দেখতে পান, নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করছে, সে সময়ই তাদের উপলব্ধি হয়- সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়া জান্তা বাহিনীকে টলানো যাবে না।
রয়টার্স তাদের ছবি এবং ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে গত সেপ্টেম্বরে। জঙ্গলে প্রশিক্ষণ নেওয়া দল এবং দেশব্যাপী অন্যান্য বেসামরিক ডিফেন্স ফোর্স সম্পর্কে মন্তব্য চেয়ে সামরিক জান্তা সরকারের মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স, কিন্তু কেউই মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে আসা সাবেক এক ফিটনেস ট্রেনার রয়টার্সকে বলেন, ‘হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া এই মুহূর্তে আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।’
তার সারা পিঠে আছে ট্যাটু। তাতে লেখা, ‘নেতৃত্ব দেওয়ার স্বাধীনতা।’ সেই সঙ্গে আঁকা আছে মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চির মুখচ্ছবি।
গত ফেব্রুয়ারিতে অভ্যূত্থানের পরপরই সুচিকে আটক করে সেনাবাহিনী, এরপর বিক্ষোভে উস্কানি এবং করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ লঙ্ঘনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে সামরিক আদালত তাকে শাস্তিও দিয়েছে।
সু চির মামলার এই রায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিন্দিত হয়েছে। তবে মিয়ানমার জান্তা বলছে, সু চির সাজাই প্রমাণ করে যে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এবং বিচার ব্যবস্থায় ‘কোন পক্ষপাতিত্ব’ নেই।
সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর মিয়ানমারে যখন গণতন্ত্রপন্থী জনগণের ব্যাপক গণবিক্ষোভ হয়েছিল, সেসময়ই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছিল দেশটির সবচেয়ে পুরোনো সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন। হাজার হাজার মানুষকে নিজেদের এলাকায় আশ্রয় দিয়েছে এই গোষ্ঠী।
তবে কারেন রাজ্যের জঙ্গলে গোপন প্রশিক্ষণের বিষয়ে কেএনইউ কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। মিয়ানমারে অভ্যুত্থানবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে দেশজুড়ে এমন আরও শত শত প্রতিরোধ গোষ্ঠী গড়ে উঠছে।
প্রশিক্ষণের এক আয়োজক বলেছেন, তাদের প্রশিক্ষণ দলে তরুণ বয়সী শতাধিক মানুষ যোগ দিয়েছেন এবং প্রতিদিনই নতুনরা আসছেন। তবে রয়টার্স নিরপেক্ষ সূত্রে এ বিষয়টি নিশ্চিত হতে পারেনি।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে সন্ধ্যার এক সময়ের বিবরণ দিয়ে বলা হয়েছে, এ সময় প্রশিক্ষণ নিতে আসা যোদ্ধারা ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে বসে গিটার এবং বেহালা বাজিয়ে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি রোমন্থন করে।
জঙ্গলের শিবিরে আসার পর সাবেক একজন প্রশিক্ষক বলেছেন, ৩ লাখ প্রশিক্ষিত সদস্যের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার কথা ভেবে প্রথমে শঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি স্বীকার করেন- প্রতিরোধ লড়াই চালিয়ে যাওয়াই জান্তার শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র পথ।
‘আমার দেশের মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি আমার প্রাণও বিসর্জন দিতে হয়, তাহলেও আমার কিছুমাত্র দুঃখ থাকবে না; বরং এটি আমার জন্য গর্ব’- রয়টার্সকে বলেন তিনি।
এসএমডব্লিউ