যারা আগুন নিয়ে খেলবে তারা পুড়ে যাবে, বাইডেনকে শি জিনপিং
ভার্চ্যুয়াল শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং তাইওয়ানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কড়া সতর্কবার্তা দিয়েছেন। ভার্চ্যুয়াল এই বৈঠকে বিশ্বের দুই পরাশক্তি নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযােগ ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর কথা বললেও সংঘাতের ব্যাপারে সুরও চড়িয়েছে।
প্রত্যাশার চেয়ে বেশি সাড়ে তিন ঘণ্টার এই অনলাইন ভিডিও সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ওয়াশিংটনে সোমবার রাত এবং বেইজিংয়ে মঙ্গলবার সকাল। ওয়াশিংটনের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেছেন, দুই নেতার এই আলোচনা ছিল শ্রদ্ধাশীল এবং সোজাসাপ্টা।
বিশ্বের দুই অর্থনৈতিক জায়ান্ট ও ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল সম্পর্ক এবং স্বশাসিত তাইওয়ান ঘিরে সৃষ্ট উত্তেজনা নিরসন এই সম্মেলনের লক্ষ্য থাকলেও পরস্পরের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে দেখা গেছে শি এবং বাইডেনকে। সম্মেলনের পর চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, শি জিনপিং বাইডেনকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন— তাইওয়ানের স্বাধীনতায় উৎসাহ দেওয়া হলে তা আগুন নিয়ে খেলার মতো হবে।
‘যুক্তরাষ্ট্রের কিছু মানুষ চীনকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তাইওয়ানকে ব্যবহার করতে চয়। এই প্রবণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং এটি আগুন নিয়ে খেলার মতোই। যারা আগুন নিয়ে খেলবে, তারা পুড়ে যাবে।’ শি জিনপিং মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন, বলছে সিনহুয়া।
শীর্ষ সম্মেলনের পর হোয়াইট হাউসের প্রকাশিত বিবৃতিতে বাইডেনের বক্তব্য অত্যন্ত পরিশীলিত মনে হলেও তাইওয়ান নিয়ে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে সুর চড়াতে দেখা গেছে।
‘তাইওয়ানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জোর দিয়ে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র... তাইওয়ানের মর্যাদার পরিবর্তন অথবা তাইওয়ান প্রণালীজুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করার একতরফা প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করে,’ বিবৃতিতে বলছে হোয়াইট হাউস।
বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের তাইওয়ানের স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেওয়ার নীতির পুনরাবৃত্তি করা হলেও এই দ্বীপের প্রতিরক্ষায় সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের মতে, সম্মেলনে তাইওয়ানের বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।
সম্মেলনে চীনের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশের সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিমদের ওপর বেইজিংয়ের ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাইডেন।
গত জানুয়ারিতে জো বাইডেনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক হওয়ার পর দুই নেতার মধ্যে দু’বার টেলিফোনে কথা হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শি জিনপিং বিদেশ সফরে অস্বীকৃতি জানানোয় তাদের মধ্যে অনলাইনে ভিডিও সম্মেলনই ছিল দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের একমাত্র উপায়।
সংঘাত নয়
হোয়াইট হাউস জোর দিয়ে বলেছে, তারা এই শীর্ষ সম্মেলন থেকে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের আশা করেনি। বরং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য এমন এক ধরনের সম্পর্কের দিকে এগোনোর লক্ষ্য ছিল; যা ব্যর্থ হবে না।
হোয়াইট হাউস থেকে টেলিভিশনের পর্দায় শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনায় বাইডেন বলেছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতা হিসাবে এটি নিশ্চিত করা নিজেদের দায়িত্ব যে, আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, যেটা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত হোক না কেন, তা যেন সংঘর্ষের দিকে না যায়। তিনি বলেন, আমাদের কিছু সাধারণ বিষয়ের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সোজাসাপ্টা আলোচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমাদের লক্ষ্য ‘সহজ, সরল প্রতিযোগিতা’ হওয়া উচিত।
বেইজিং থেকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাইডেনকে ‘আমার পুরোনো বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তবে তিনি বলেছেন, দুই দেশকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হবে।
রুদ্ধদ্বার সম্মেলনে দোভাষীর সাহায্যে শি জিনপিং বলেছেন, ‘আমরা একত্রে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি এবং জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ ও সহযোগিতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন।
বর্তমান বিশ্বের প্রধান সংকট— বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দুই দেশের একসঙ্গে কাজের ওপর জোর দিয়েছেন জো বাইডেন এবং শি জিনপিং। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ এবং স্থিতিশীল বৈশ্বিক পরিবেশ’ রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সৃদৃঢ় এবং স্থিতিশীল সম্পর্ক প্রয়োজন।
খোশ মেজাজে বাইডেন
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে দুই দেশের সম্পর্ক একেবারে তলানিতে পৌঁছায়। ওই সময় চীনের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর পাশাপাশি উহান থেকে করোনাভাইরাস মহামারির উৎপত্তির আন্তর্জাতিক তদন্ত নিয়ে বেইজিংয়ের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন ট্রাম্প।
বাইডেন সেই দ্বন্দ্বকে গণতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই বলে আরও বিস্তৃত করেন। এতে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপে সমর্থন জানান।
শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সম্মেলনের পর অর্ধ-শতাব্দির বেশি সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সোমবার সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্যাকেজ আইনে স্বাক্ষর করেছেন জো বাইডেন। বছরের পর বছর চীনের বিনিয়োগ ধরার গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হিসেবে এই প্যাকেজকে বর্ণনা করেছেন তিনি।
হোয়াইট হাউসে দেওয়া এক বক্তৃতায় জো বাইডেন বলেছেন, ‘বিশ্ব বদলে যাচ্ছে। আমাদের প্রস্তুত হতে হবে।’
ট্রাম্পের আমলের চেয়ে বর্তমানে চীনের বাগাড়ম্বর কিছুটা নিচু হলেও তাইওয়ানকে ঘিরে শুরু হওয়া উত্তেজনা নতুন ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার হুমকি তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে তাইওয়ানের আশপাশে সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে চীন। চলতি বছরের অক্টোবরে এই দ্বীপ ভূখণ্ডের আকাশসীমায় চীনের যুদ্ধবিমানের রেকর্ড অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা তাইওয়ানের আত্ম-প্রতিরক্ষায় সমর্থন জানায়। তবে তাইওয়ানকে সরাসরি সহায়তার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে কি-না সেটি পরিষ্কার নয়।
দুই প্রেসিডেন্টের ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনের পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্ব এখন বাইডেনের ওপর বলে মন্তব্য করেছে।
সূত্র: এএফপি।
এসএস