ভারতে তৈরি টিকা নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
মহামারি ডেকে আনা করোনাভাইরাসের দুটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে ভারত। এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে প্রতিবেশি দেশগুলোতেও হাজার হাজার টিকার ডোজ পাঠানো শুরু করেছে দেশটি। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ভারতে এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি মানুষকে করোনার দুটি টিকা দেয়া হয়েছে।
এর একটি হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধপ্রস্তুতকারক কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকা; ভারতে যার নাম দেয়া হয়েছে ‘কোভিশিল্ড।’ আর দ্বিতীয়টি হলো কোভ্যাক্সিন; যা ভারত-বায়োটেক নামে একটি স্থানীয় ফার্মসিউটিক্যাল কোম্পানির তৈরি।
ভারতের ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এই দুটি টিকাকেই সবুজ সংকেত দিয়েছে। ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার পরপরই দেশটি তার প্রতিবেশি দেশগুলোতে করোনার হাজার হাজার ডোজ টিকা পাঠিয়েছে।
কীভাবে কাজ করে কোভ্যাক্সিন?
বিশ্বে টিকা উৎপাদনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে ভারত। তাদের ছয়টি বড় আকারের টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আছে; যা পৃথিবীর ৬০ শতাংশ টিকা উৎপাদন করে।
ভারত বায়োটেক নামে ২৪ বছরের পুরোনো একটি টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি এই কোভ্যাক্সিন উদ্ভাবন করেছে। তারা এযাবৎ ১৬টি টিকা তৈরি করেছে এবং ১২৩টি দেশে তা রপ্তানি করে।
কোভ্যক্সিন টিকাটি তৈরি হয়েছে মৃত করোনাভাইরাস দিয়ে; এটিকে বলা হয় ইনঅ্যাক্টিভেটেড ভ্যাকসিন- যা নিরাপদে ইনজেকশন আকারে মানুষের শরীরে দেয়া যায়। ভারত বায়োটেক এ জন্য করোনাভাইরাসের একটি নমুনা ব্যবহার করেছে; যা পৃথক করেছে দেশটির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি।
এটা মানবদেহে ইনজেকশন আকারে দেয়া হলে রোগপ্রতিরোধী দেহকোষগুলো তখনও মৃত করোনাভাইরাসকে শনাক্ত এবং দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জাগিয়ে তোলে। তখন ভাইরাসটির বিরুদ্ধে দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে থাকে।
কোভ্যাক্সিনের কত ডোজ দিতে হয়?
চার সপ্তাহের ব্যবধানে কোভ্যাক্সিনের দুটি ডোজ নিতে হয়। ভ্যাকসিনটি সংরক্ষণ করতে হয় ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। ভারত বায়োটেক বলছে, তাদের কাছে দুই কোটি ডোজ কোভ্যাক্সিনের মজুত আছে। এছাড়া তাদের লক্ষ্য- এ বছরের শেষ নাগাদ ভারতের দুটি শহরে থাকা তাদের চারটি কারখানা থেকে ৭০ কোটি টিকা তৈরি করা হবে।
কোভ্যাক্সিন নিয়ে বিতর্ক কেন?
বিতর্কের শুরু হয় ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটি বক্তব্যের পর। তারা জানায়, জরুরি পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে পূর্ব-সতর্কতা হিসেবে সীমিত ব্যবহারের জন্য এই টিকার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, যখন টিকাটির ট্রায়াল চলছে তখন কীভাবে লক্ষ লক্ষ ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জরুরি ব্যবহারের জন্য এটাকে অনুমোদন দেয়া হলো?
টিকা উৎপাদনকারী এবং ওষুধ নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ জবাবে বলেছে, কোভ্যাক্সিন নিরাপদ এবং এটা মানবদেহে জোরালো রোগ প্রতিরোধী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তবে অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক নামে একটি সংস্থা বলছে, অসম্পূর্ণ জরিপকৃত একটি টিকা অনুমোদনের বৈজ্ঞানিক যুক্তি তাদের কাছে বোধগম্য নয় এবং এর কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনও উপাত্ত না থাকার ফলে তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
ভারত বায়োটেক তাদের টিকা অনুমোদনের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেছে, ভারতের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আইনে প্রাণঘাতী রোগ মোকাবিলার স্বার্থে দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের পরই কোন ওষুধকে দ্রুত অনুমোদন দেয়ার সুযোগ আছে। তারা বলেছে, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই তারা টিকার কার্যকারিতার উপাত্ত প্রকাশ করবে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কেমন?
ভারতে করোনাভাইরাসের টিকা নেয়ার পর ছয় শতাধিক মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা এবং বমিভাব। এসব উপসর্গকে টিকাদানের বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেটাকে অ্যাডভার্স ইভেন্ট ফলোইং ইমিউনাজেশন (এইএফআই) বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, যার সাথে সরাসরি টিকা বা টিকাদান প্রক্রিয়ার সরাসরি সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।
টিকার সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক আছে?
দেশটির উত্তরপ্রদেশের একটি সরকারি হাসপাতালের ৪৬ বছর বয়সী একজন কর্মী টিকা নেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর মারা গেছেন। প্রদেশের সরকার বলছে, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে হার্ট এবং ফুসফুসের রোগজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
তবে সেখানকার এক মেডিক্যাল কর্মকর্তা বলেছেন, টিকা নেয়ার সাথে এই মৃত্যুর কোনও সম্পর্ক নেই।
এছাড়া যাদের মধ্যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তাদের মধ্যে কারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকার টিকা আর কারা ভারত বায়োটেকের কোভ্যাক্সিন নিয়েছেন- সেই পরিসংখ্যান অবশ্য সরকার প্রকাশ করেনি।
কোভিশিল্ডের কার্যকারিতা কেমন?
অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি স্থানীয়ভাবে তৈরি করছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট; যারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক এবং প্রতিমাসে পাঁচ কোটি টিকা তৈরি করে। ভারতে কোভিশিল্ড নামে পরিচিত এ টিকাটি সাধারণ সর্দিজ্বরের ভাইরাসের একটি দুর্বল সংস্করণ থেকে তৈরি। এটি শিম্পাঞ্জির দেহে হয় এবং এর নাম অ্যাডেনোভাইরাস।
টিকা তৈরির জন্য এটাকে এমনভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে; যাতে এটা দেখতে অনেকটা করোনাভাইরাসের মত হয়। তবে তা মানবদেহে কোন অসুস্থতা তৈরি করতে পারে না। এটা দেয়া হলে মানবদেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে শুরু করে এবং যেকোনও রকম করোনাভাইরাস দেহে ঢুকলে তাকে আক্রমণ করতে শিখে যায়।
চার থেকে ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজটি দেয়া হয় এবং এটি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়। ফলে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার চেয়ে এটি সহজে বিতরণ করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, অক্সফোর্ড- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি প্রথমে আধা ডোজ এবং পরে পুরো ডোজ দেয়া হলে তার কার্যকারিতা ৯০ শতাংশ।
তবে এই পদ্ধতিতে টিকাটি দেওয়ার পক্ষে পরিষ্কার তথ্য নেই। কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের মধ্যে দীর্ঘবিরতি দিলে তার কার্যকারিতা বেড়ে যেতে দেখা গেছে এবং অপ্রকাশিত উপাত্তে আভাস মিলেছে যে, তা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
সেরাম ইনস্টিটিউট বলছে, কোভিশিল্ড উচ্চমাত্রায় কার্যকর এবং ব্রাজিল ও যুক্তরাজ্যে তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের উপাত্তে তার সমর্থন মিলেছে।
অবশ্য অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক নামে রোগী-অধিকার গোষ্ঠী বলছে, ভারতীয়দের ওপর এ টিকার জরিপ সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। সেরাম ইনস্টিটিউট বলেছে, ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতে ট্রায়ালটি শেষ করার চেষ্টা করা হবে।
এদিকে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে টিকাটির কার্যকারিতা প্রমাণিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই। যেহেতু ইতোমধ্যে বিভিন্ন বয়স ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে।
ভ্যাকসিন কূটনীতি
ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড এর মধ্যেই বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও সিসিলেসে পাঠানো হচ্ছে। এসব চালানের কিছু উপহার হিসেবে এবং কিছু সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে করা বাণিজ্যিক চুক্তির অধীনে যাচ্ছে। বিবিসি।
এসএস