সিরিয়া যুদ্ধে অন্তত সাড়ে তিন লাখ প্রাণহানি
সিরিয়ায় দশ বছরের যুদ্ধে কমপক্ষে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৯ জনের প্রাণহানি হয়েছে। শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়। সংস্থাটি বলছে, এই হিসাবও সঠিক নয়। কারণ অনেক মানুষের মৃত্যুর রেকর্ড পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে মৃত্যুর হিসাব দিল মানবাধিকার কার্যালয়। খবর আল-জাজিরার।
শুক্রবার জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় থেকে দেওয়া এই হিসাবে সাধারণ মানুষের সঙ্গে লড়াইরত যোদ্ধাদেরও রাখা হয়েছে। নিহতের পূর্ণ নাম, মৃত্যুর তারিখ, কোথায় নিহত হয়েছে, সব নিয়ম কঠোরভাবে মেনে এই হিসাব দিয়েছে সংস্থাটি। এ কারণেই বলা হচ্ছে, এই হিসাব আনুমানিক। প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটা আরও বেশি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বলেছেন, ‘এসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা ৩ লাখ ৫০ হাজার ২০৯ জনের মৃত্যুর একটি তালিকা তৈরি করেছি। ২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে এসব মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। নিহত প্রতি ১৩ জনের মধ্যে একজন নারী অথবা শিশু।’
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী মিশেল ব্যাচলেট আরও বলেন, ‘এটা সর্বনিম্ন প্রমাণিত মৃত্যুর সংখ্যা। অবশ্যই প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি। সিরিয়ায় প্রাণহানি নিয়ে তার কার্যালয় থেকে সবশেষ হিসাব দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালের আগস্টে। তখন সংখ্যাটা ছিল অন্তত ১ লাখ ৯১ হাজার ৩৬৯ জন।’
সবচেয়ে বেশি ৫১ হাজার ৭৩১ জন নিহত হয়েছে আলেপ্পোতে। দীর্ঘদিন এই অঞ্চলটি বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল মিশেল ব্যাচলেট জানিয়েছেন, আরও পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ মৃত্যুর হিসাব দেওয়ার জন্য তার কার্যালয় পরিসংখ্যানগত একটি মডেল নিয়ে কাজ করছে; যা কিছু মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে বিচারের ভিত্তি তৈরিতে সাহায্য করবে।
এছাড়া দেশটিতে আটক লাখো মানুষ এখনো নিখোঁজ। জাতিসংঘ এর আগে জানিয়েছিল, আটক এসব মানুষ বীভৎস নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট নিখোঁজ এসব মানুষদের নিয়ে তদন্তের জন্য স্বাধীন কোনো কৌশল কিংবা পদ্ধতি তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘সিরিয়ায় বহু মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমি একটি স্বাধীন পদ্ধতি তৈরির জন্য পুনরায় আহ্বান জানাচ্ছি। একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক কমিশন গঠনের মাধ্যমে নিখোঁজদের ভাগ্য এবং অবস্থান স্পষ্ট করা, এসব মানুষের দেহাবশেষ চিহ্নিত করা এবং আত্মীয়দের সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করুন।’
তবে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মনাবাধিকার সংস্থা সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে এই যুদ্ধে ৫ লাখ মানুষ মারা গেছে সিরিয়ায়। যাদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বেসামরিক নাগরিক। এর বাইরেও নিখোঁজ রয়েছেন বহু মানুষ। সংস্থাটির মতে আরও দুই লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
কিভাবে যুদ্ধ শুরু হলো সিরিয়ায়?
২০১১ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয় দক্ষিণের শহর ডেরায়। তবে বিক্ষোভ শুরুর অনেক আগে থেকেই দেশটিতে কর্মসংস্থানের অভাব আর দুর্নীতির মত নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। স্বতস্ফূর্ত এই বিক্ষোভকে বিদেশি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসবাদ আখ্যা দেন প্রেসিডেন্ট আসাদ।
বিক্ষোভকারীদের ওপর চড়াও হয় সরকারি বাহিনী। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবি ওঠে দেশজুড়ে। সরকারের অভিযানও জোরদার হলে বিদ্রোহীরা শুরুতে নিজেদের জীবন রক্ষার্থে অস্ত্রধারণ করে। পরে তার একত্রিত হয়ে নিজ এলাকার সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় দেশটিতে।
দীর্ঘ এই যুদ্ধের কারণে মানুষ সিরিয়া ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর হিসাবে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সিরিয়া ছেড়ে গেছে। লেবানন, জার্মানি, ইরান ও তুরস্ক সিরিয়ার শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়। তাদের অনেকে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে আরও ভালো সুবিধা পাওয়ার জন্য।
রাজনৈতিক স্বার্থে আসাদের বড় সমর্থক রাশিয়া। কারণ সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে বন্ধুভাবাপন্ন দেশ। আসাদ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে সিরিয়ার সাথে রাশিয়ার সন্ধিও টিকে থাকবে না। আসাদ যু্দ্ধে পরাজিত হলে ভূমধ্যসাগরে সিরিয়ার তারতুস নৌঘাঁটিও হাতছাড়া হয়ে যাবে। এছাড়া ইরানও আসাদকে সমর্থন দিয়ে এসেছে।
তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি পশ্চিমা রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় সিরিয়ার বিদ্রোহীদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাশিয়ার বিমান সহায়তা আর ইরানের সেনা সমর্থনে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের দমন করতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস নামের একটি প্রশিক্ষিত ও সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এএস