হাইবাতুল্লাহ-বারাদারের খবর নিয়ে বিভ্রান্তি
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ম্যাগাজিন দ্য স্পেকটেটরের বরাত দিয়ে ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যম আফগানিস্তানে তালেবানের প্রধান দুই নেতা— উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা বারাদার এবং তালেবানের প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা ক্ষমতার লড়াইয়ের শিকার হয়েছেন বলে জানায়।
ব্রিটিশ ওই গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া, হিন্দুস্তান টাইমস, জিফাইভসহ আরও বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম এই খবর প্রকাশ করে; যদিও বিশ্বের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোর ওয়েবসাইটে এই সংবাদটি পাওয়া যায়নি।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, ‘আফগানিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা বারাদারকে কি কান্দাহারে জিম্মি করে রাখা হয়েছে? তালেবানের প্রধান হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা কি নিহত হয়েছেন? প্রাথমিকভাবে আফগানিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোর শীর্ষ এক এবং দুই নম্বরে থাকা তালেবানের দুই নেতাকে ঘিরে এ ধরনের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে।’
সোমবার ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য স্পেকটেটরের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানায় ভারতীয় একাধিক গণমাধ্যম। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি মাসের শুরুর দিকে কাবুলের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের একজন নেতার আক্রমণের শিকার হয়েছেন মোল্লা বারাদার। এরপর থেকে তাকে জনসম্মুখে খুব বেশি দেখা যায়নি। যদিও গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন টেলিভিশনে এসে নিজের আহত কিংবা নিহত হওয়ার খবরকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।
হিন্দুস্তান টাইমসও প্রায় একই ধরনের তথ্য জানিয়ে প্রতিবেদনে লিখেছে, বারাদার গোষ্ঠী এবং হাক্কানি নেটওয়ার্কের মধ্যে সরকার গঠনের আলোচনায় সাম্প্রতিক সংঘাতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বারাদারই।
আফগানিস্তানের নতুন সরকারে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলোর আরও বেশি সংশ্লিষ্টতা চেয়েছিলেন বারাদার। এছাড়া তালেবানের পতাকার পাশাপাশি আফগানিস্তানের পতাকাও উড়ানোর যুক্তি দিয়েছিলেন তিনি।
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, ‘আলোচনায় মোল্লা বারাদার অন্তর্ভুক্তিমূলক মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দেন; যে মন্ত্রিসভায় অ-তালেবান নেতা, জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি চেয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এ ধরনের মন্ত্রিসভা গঠন করা হলে পুরো বিশ্বের কাছে তা বেশি গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু বৈঠকের এক পর্যায়ে চরমপন্থী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের নেতা খলিল উল রহমান হাক্কানি তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং মোল্লা আব্দুল গনি বারাদারকে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করেন। এ সময় বারাদার ও হাক্কানির সমর্থকদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের টেবিলে রাখা চায়ের বিশাল ফ্ল্যাস্ক ও অন্যান্য আসবাবপত্র পড়ে যায়।’
এই ঘটনার পর অক্ষত অবস্থায় রাজধানী কাবুল ছেড়ে কান্দাহারে তালেবানের ঘাঁটিতে তাদের সর্বোচ্চ ও আধ্যাত্মিক নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার কাছে চলে যান বারাদার।
দ্য স্পেকটেটরের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ‘মোল্লা বারাদার উপজাতীয় জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন; যারা তাকে সমর্থন করেন। কিন্তু একই সময়ে রাষ্ট্রীয়-মালিকানাধীন টেলিভিশন নেটওয়ার্কে একটি বিবৃতি পাঠে তাকে বাধ্য করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বারাদার যে বার্তা দিয়েছেন সেটি জিম্মি ভিডিও বার্তার মতো মনে হয়েছে। ওই টেলিভিশনের নিয়ন্ত্রণ এখন তালেবানের হাতে রয়েছে।’
এদিকে, বারাদারের আহত এবং আখুন্দজাদার মারা যাওয়ার তথ্য গত কয়েকদিন ধরে বারবার অস্বীকার করে আসছেন তালেবানের নেতারা। গত ১৫ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজউদ্দিন হাক্কানির ছোট ভাই আনাস হাক্কানি টুইটারে দেওয়া কে বিবৃতিতে তালেবানের অভ্যন্তরীণ বিবাদের তথ্য অস্বীকার করেন।
তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহিন বলেছেন, তালেবানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সাবেক প্রধান ও নতুন আফগান উপ-প্রধানমন্ত্রী মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার এক অডিও বার্তায় সংঘাতে ‘আহত অথবা নিহত’ হওয়ার খবরকে গুজব বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সুহাইল শাহিন টুইট বার্তায় লিখেছেন, এটি মিথ্যা এবং পুরোপুরি ভিত্তিহীন। টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং হিন্দুস্তান টাইমস দাবি করেছে, মন্ত্রিসভা গঠনের আলোচনার সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান জেনারেল ফাইজ হামিদ কাবুলে ছিলেন; তিনি বারাদারের পরিবর্তে হাক্কানিদের সমর্থন দেন। যদিও শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানের কারাগারে আট বছর বন্দি থাকা বারাদারকে মুক্ত করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন।
ভারতীয় এ দুই দৈনিক বলছে, আইএসআই প্রধান আফগানিস্তানের নতুন সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ পদ পাকিস্তানের অনুগতদের জন্য নিশ্চিত করেন। সরকারের প্রধান পদগুলোতে চরমপন্থী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া দোহা শান্তি আলোচনায় যারা অংশ নিয়েছিলেন নতুন সরকারে তারা উপেক্ষিত হন।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বারাদার এবং হাক্কানির দেহরক্ষীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে ঢুকে একে অপরকে লক্ষ্য করে চালানো গুলিতে অনেকে নিহত এবং আহত হয়েছেন বলেও জানিয়েছে।
তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার ব্যাপারে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তালেবানের প্রধান আখুন্দজাদাকে কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের অনেক গুঞ্জন রয়েছে যে, তিনি খুন হয়েছেন। যদিও তালেবানের সর্বোচ্চ এই নেতাকে কখনোই সরাসরি বিশ্বের সামনে হাজির হতে দেখা যায়নি। তিনি সবসময় আড়ালে থেকে ভিডিও বার্তা পাঠান এবং দলের নেতাদের নির্দেশনা দেন।
এমনকি গত ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুলের দখল নেওয়ার পর মোল্লা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। তবে নতুন সরকার গঠনের সময় গত সপ্তাহে একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন তিনি।
বারাদার কান্দাহারে থাকলেও হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা কোথায় আছেন তা এখনও জানা যায়নি। তালেবান বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, আখুন্দজাদা শিগগিরই জনসম্মুখে আসবেন; কিন্তু এখন পর্যন্ত তাকে দেখা যায়নি। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আখুন্দজাদার জনসম্মুখে না আসাই ওই গুঞ্জনের ডানা মেলেছে।
দ্য স্পেকটেটরের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, আখুন্দজাদা হয়তো মারা গেছেন। ২০১৩ সালেও একই ধরনের গুজব ছড়িয়েছিল তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যু ঘিরে। ওমরের মৃত্যুর তথ্য প্রায় দুই বছর পর ২০১৫ সালে স্বীকার করে তালেবান।
এসএস