পাণ্ডিত্য আর ছায়াময় অস্তিত্বে সর্বোচ্চ নেতার পদে হাইবাতুল্লাহ
তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার একটি মাত্র ছবিই পাওয়া যায়, যে ছবিতে তিনি সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাথায় সাদা পাগড়ি, ধূসর লম্বা দাড়ি। অভিব্যক্তিহীন বিবর্ণ এক মুখ।
গত মাসে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসা ইসলামি আন্দোলন তালেবান মঙ্গলবার তাদের নতুন সরকার ঘোষণা করেছে। এই গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতা রহস্যময় হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা; ২০১৬ সাল থেকে তালেবানের রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামরিক বিষয়ে চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী হিসেবে এই পদে আছেন তিনি।
আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো এক লিখিত বিবৃতিতে তালেবানের সর্বোচ্চ এই নেতা বলেন, ‘আমাদের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে আমরাই পুনর্গঠন করব।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামি আইনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়; এমন সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতির প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ তালেবান। যে ইসলামি আইনে এখন থেকে আফগানিস্তানের পুরো শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হবে।’
একজন আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীর বাবা কট্টরপন্থী ধর্মীয় পণ্ডিত হিসেবে তালেবানের ভেতরে পরিচিত আখুন্দজাদা তার নেতৃত্বের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন ছায়ায়, সংকট সমাধানের আলোচনায় সবসময়ই অন্যদের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন; যা শেষ পর্যন্ত ২০ বছরের জঙ্গিবিরোধী যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আফগানিস্তান ত্যাগে বাধ্য করেছে।
আরও পড়ুন: আফগান নতুন প্রধানমন্ত্রী কে এই মোল্লা হাসান আখুন্দ?
তার বয়সের মতো মৌলিক বিষয়টিও যাচাই করা কঠিন। তবে আখুন্দজাদার বয়স ৬০ এর কাছাকাছি হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তালেবান নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন কয়েকজন বিশ্লেষক বলেছেন, ‘তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। দলের ভেতর বিভাজন নিষ্পত্তি এবং সামরিক বিজয়ের আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মিত্র ও শত্রুদের সামলাতেই বেশি ভূমিকা রেখেছেন তিনি।’
জাহাজের মাস্তুল
সিঙ্গাপুরের নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির সিকিউরিটি স্টাডিজের অধ্যাপক রোহান গুনারত্ন বলেন, ‘ধূর্ততা, প্রতারণা, কারসাজি এবং ধৈর্যের মাধ্যমে তিনি তালেবানকে আবার ক্ষমতায় আনতে সক্ষম হয়েছেন।’
কিন্তু অন্যান্যরা বলছেন, ‘তিনি জাহাজের মাস্তুলের চেয়েও বেশি কিছু। তালেবানের আন্দোলনের সময় তাকে একজন আপসকামী প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। যে সময় প্রকৃত ক্ষমতা তালেবানের সামরিক শাখার হাতে ছিল।’
নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট স্টাডিজের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাজেশ্বরী কৃষ্ণমূর্তি বলেছেন, ‘তার সম্পর্কে খুব কমই তথ্য পাওয়া যায়। আপনি তাকে প্রকাশ্যে কিছু বলতে দেখবেন না।’
আফগানিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কান্দাহারের কট্টর এক ধার্মিক পরিবারে জন্ম আখুন্দজাদার। আফগান গৃহযুদ্ধের ছাই থেকে হেলমান্দ প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠা তালেবানের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের একজন তিনি।
আরও পড়ুন: তাসের ঘরের মতো কেন ভেঙে পড়ল আফগান সেনাবাহিনী?
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান যখন কঠোর ইসলামি শরিয়া আইন অনুযায়ী আফগানিস্তান শাসন করে; আখুন্দজাদা সেই সময় সরকারের প্রধান বিচারপতি হিসেবে কাজ করেন। ওই সময় আফগানিস্তানে নারীদের চাকরি নিষিদ্ধ এবং ব্যভিচারের শাস্তি হিসেবে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিধান চালু করে তালেবান।
পাণ্ডিত্যপূর্ণ শাসক আর উগ্র বক্তার তকমা
১১ সেপ্টেম্বরের হামলাকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা এবং তালেবানের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রয়টার্স এক প্রতিবেদনে বলেছিল, পাকিস্তানে পালিয়েছেন আখুন্দজাদা। যেখানে তিনি ১৫ বছর ধরে একটি মসজিদে ইমামতি এবং ধর্ম প্রচার করেছেন।
মসজিদে তার শিক্ষার্থী এবং সহকর্মীরা আখুন্দজাদাকে একজন ‘পাণ্ডিত্যপূর্ণ শাসক’ এবং ‘উগ্র বক্তা’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০১৪ সালে কোয়েটায় এক সমাবেশে দেওয়া আখুন্দজাদার বক্তৃতার কথা স্মরণ করে তার সাবেক এক সহকর্মী বলেন, ‘তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুদ্ধ সম্পর্কে অনেক সাহসিকতাপূর্ণ কথাবার্তা বলতেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা আমাদের জিহাদ ছেড়ে দেব না।’
যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় তালেবানের নেতা মোল্লা আখতার মনসুরের মৃত্যুর পর নতুন প্রধান নির্বাচনের জন্য ২০১৬ সালে এই গোষ্ঠীর জ্যেষ্ঠ সদস্যরা এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময় আখুন্দজাদাকে অবধারিতভাবে বেছে নেওয়ার উপায় ছিল না। আখুন্দজাদা আফগানিস্তানের বৃহৎ এবং শক্তিশালী নূরজাই গোত্রের সদস্য। তালেবানের অন্যান্য নেতাদের সামরিক বিচক্ষণতার তুলনায় তাকে পণ্ডিত হিসেবেই বেশি দেখা হয়।
আরও পড়ুন: পিএইচডি-মাস্টার্স ডিগ্রির মূল্য নেই: আফগান শিক্ষামন্ত্রী
২০০৮ সালে কাবুলে হোটেলে প্রাণঘাতী হামলার সঙ্গে জড়িত আফগানিস্তানের চরমপন্থী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কের সিরাজউদ্দিন হাক্কানি এবং তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত মোল্লা ওমরের ছোট ও অনভিজ্ঞ ছেলের মধ্যে সমঝোতা করতে হয় আখুন্দজাদাকে।
আখুন্দজাদায় মত্ত আল-কায়েদা প্রধানের আনুগত্য
আখুন্দজাদা তালেবানের নেতার দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই এক অনলাইন অডিও বার্তায় তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন আল-কায়েদার প্রধান আয়মান আল-জাওয়াহিরি। তালেবানের অন্যান্য নেতাদের মতো জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই আখুন্দজাদা। তার ছেলে আব্দুর রহমান ২০১৭ সালে হেলমান্দ প্রদেশে আফগান সামরিক বাহিনীর একটি ঘাঁটিতে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেন, বলেছেন তালেবানের একজন মুখপাত্র।
নেতৃত্বের প্রথম দিকে আখুন্দজাদা তালেবানে এমন সব সংস্কার আনেন; যা এই গোষ্ঠীর বিভাজন এবং সদস্যদের দলত্যাগের কারণে দুর্বল হয়ে যাওয়া আন্দোলনের ওপর তার প্রভাব সুসংহত করে। কিন্তু তিনি সবসময় নিজেকে নিম্নসারিতে রেখেছেন। জনসম্মুখে এসেছেন একেবারে কম।
তার একমাত্র যে ছবিটি রয়টার্স যাচাই-বাছাই শেষে নিশ্চিত হতে পেরেছে যে এটি আখুন্দজাদারই; সেটি ২০১৬ সালের মে মাসে তালেবানের টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রথম টুইট করা হয়। তালেবানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাও ছবিটির সত্যতা পৃথকভাবে নিশ্চিত করেছেন; যারা নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তালেবানের এই নেতার ছায়াময় অস্তিত্ব তার অবস্থান এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে বারবার জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে। তালেবান তাদের নেতাদের ব্যাপারে এতটাই গোপনীয়তা অবলম্বন করে যে, ২০১৩ সালে তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমরের মৃত্যুর দুই বছর পর সেটি প্রকাশ করা হয়। ওমরের মৃত্যুর তথ্য তার ছেলে প্রথম প্রকাশ্যে স্বীকার করেন।
এসএস