গুলিতে হারানো মাথার খুলি কোথায়, দুঃসহ স্মৃতিচারণে জানালেন মালালা
তালেবানের গুলিতে বিদ্ধ হওয়ার ৯ বছর পর পাকিস্তানের ক্ষুদে মানবাধিকার কর্মী ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই সশস্ত্র ইসলামি এই গোষ্ঠীর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তালেবান ক্ষমতায় ফেরায় আফগান নাগরিকদের দুর্দশার প্রতি বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণের ওপর আবারও জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
পোডিয়ামে প্রকাশিত এক পোস্টে ২৪ বছর বয়সী এই মানবাধিকার কর্মী বলেছেন, আমি সেসব মানুষদের হাতে একের পর এক প্রদেশ পতন হতে দেখেছি; যাদের হাতে বুলেটভর্তি বন্দুক। একেকটি প্রদেশের পতনে আমার মনে হয়েছে, আমাকে একে একে গুলি করা হচ্ছে।
পাকিস্তানে তালেবানের সদস্যরা ২০১২ সালে নারী শিক্ষা অধিকার নিয়ে কাজ করা মালালা ইউসুফজাইয়ের মাথায় গুলি করে। সেই স্মৃতিচারণ করে মালালা লিখেছেন, ২০১২ সালের অক্টোবরের কথা। পাকিস্তানি তালেবানের এক সদস্য আমার স্কুল বাসে উঠেছিল এবং আমার মাথার বামপাশে একটি গুলি ছোড়ে। বুলেটটি আমার বাম চোখ, মাথার খুলি এবং মস্তিষ্কে আঘাত হানে— আমার ত্বকে ক্ষত সৃষ্টি করে, কানের পর্দা ফেটে যায় এবং চোয়াল ভেঙে যায়।
পাক এই মানবাধিকার কর্মী সেদিনের ঘটনার পরের স্মৃতি তুলে করেছেন। যদিও যেদিন গুলি করা হয়েছিল সেদিনের ঘটনা এখনও মনে করতে পারেন না তিনি। পোস্টে শারীরিক এবং মানসিক ভয়ের ব্যাপারে কথা বলেছেন মালালা ইউসুফজাই। বলেছেন, তিনি এবং তার বন্ধুরা যারা ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন; তারা এখনও সেই ভয়ানক স্মৃতি সঙ্গী করে চলছেন। মালালা লিখেছেন, আমি এখনও সেই দাগ বহন করছি; যেখান থেকে চিকিৎসকরা বুলেটটি সরিয়ে দিয়েছেন।
কিছু দিন আগে মালালা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে ফোন করেছিলেন; গুলিবিদ্ধ হওয়ার দিন বাসে তার পাশেই বসা ছিলেন সেই বন্ধু। সেদিনের কোনও কিছুই মনে না থাকায় ৯ বছর আগের ওই দিন কি ঘটেছিল তা জানতে বন্ধুকে ফোন করেন মালালা।
বন্ধুর কাছে জানতে চান, ‘আমি কি সেদিন চিৎকার করেছিলাম? আমি কি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম?’ জবাবে তার বন্ধু বলেন, ‘না। তালেবানের ওই সদস্য বাসে দাঁড়িয়ে মালালা কে জানতে চাওয়ায় তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিলে। তুমি আমার হাত এত শক্ত করে ধরে রেখেছ যে, আমি কয়েকদিন ধরে ব্যথা অনুভব করেছি।’
তার বন্ধুর ভাষ্য, তালেবানের ওই সদস্য মালালার মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ মালালা হাত দিয়ে মাথার একপাশ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করলেও মুহূর্তের মধ্যে ঢলে পড়ে যায়।
‘তুমি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেছ। কিন্তু সেকেন্ডের মধ্যেই তুমি আমার কোলে ঢলে পড়ো।’
সেদিনের এই দুঃসহ স্মৃতি সম্পর্কে এখন মালালার কোনও কিছুই মনে নেই। কিন্তু তার বন্ধুরা দুঃস্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছেন। ‘আমার শরীরে একটি গুলির এবং অনেক অস্ত্রোপচারের দাগ আছে। আমার সেদিনের কোনও স্মৃতিই মনে নেই। কিন্তু ৯ বছর পরও আমার সেরা সেই বন্ধুকে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে।’
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মস্তিষ্ক ফুলে যাওয়ায় পেশোয়ারের সার্জনরা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার বামপাশের খুলির হাড় সাময়িক সরিয়ে ফেলেন। চিকিৎসকদের দ্রুত এই পদক্ষেপে বেঁচে যায় মালালার প্রাণ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। পরে বিমানে করে তাকে প্রথমে রাজধানী ইসলামাবাদে এবং পরে সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে নেওয়া হয়।
মালালা বলেন, ‘যখন আমি চোখ খুললাম, তখন আমি বেঁচে আছি বুঝতে পেরে স্বস্তিবোধ করলাম। কিন্তু আমি জানি না কোথায় আছি অথবা ইংরেজিতে কথা বলা অপরিচিত লোকজন কেন আমাকে ঘিরে ধরে আছেন।’
মাথায় গুরুতর ব্যথা এবং ঝাপসা দৃষ্টিশক্তি নিয়ে লড়াই করার সময় হাসপাতালের কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একটি নোটবুকে স্মৃতিগুলো লিখতে শুরু করেছিলেন মালালা। সেই সময় একদিন এক নার্সের কাছে আয়না চেয়ে নিয়েছিলেন। যেখানে প্রথম দর্শনে তিনি তার অর্ধেক মুখ চিনতে পারেন, বাকি অর্ধেক ছিল প্রায় অচল।
হাসপাতালের দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করে মালালা বলেন, ‘আমার মাথার অর্ধেক ন্যাড়া করা হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম, এটা তালেবানই মনে হয় করেছে। কিন্তু নার্স বলেছেন, চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের জন্য এটা করেছেন।’
যখন পেট স্পর্শ করলেন তখন সেখানে শক্ত কিছু অনুভব করলেন মালালা। তাকে বলা হয়েছিল যে, পাকিস্তানের সার্জনরা তার মাথার খুলির হাড়ের কিছু অংশ সরিয়ে নিয়েছিলেন এবং তারা এটিকে তার পেটে যুক্ত করে দিয়েছিলেন, যাতে একদিন পুনরায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তা ফিরে পাওয়া যায়।
সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে তার মাথার খুলির হাড় লাগানোর জায়গায় যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকরা একটি টাইটানিয়াম প্লেট লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন। আজ মাথার খুলির হাড়ের সেই টুকরো মালালার বইয়ের তাকে স্থান পেয়েছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর মালালা ইউসুফজাই তার সুস্থ হয়ে ওঠার দীর্ঘ প্রক্রিয়া সম্পর্কে মুখ খুললেন। পোডিয়াম পোস্টে মালালা বলেছেন, ‘আমার শরীরে তালেবানের ক্ষত সারানোর জন্য ষষ্ঠবারের মতো অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।’
তিনি লিখেছেন, ‘গত ৯ আগস্ট আমার সর্বশেষ অস্ত্রোপচারের জন্য হাসপাতালে যাওয়ার সময় নির্ধারণ ছিল। ওই দিন ভোর ৫ টায় ঘুম থেকে উঠেছিলাম এবং খবরে দেখলাম, তালেবান আফগানিস্তানের প্রথম বড় শহর কুন্দুজের দখল নিয়েছে।’
পরের কয়েকদিন মালালা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছেন, কয়েকজনকে টেলিফোন করেছেন এবং আফগানিস্তানের নারী মানবাধিকার কর্মীদের সাথে এখনও কথা বলছেন। আফগানিস্তানের অনেক নারী মানবাধিকার কর্মীকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সাহায্য করেছেন তিনি।
শান্তিতে নোবেলজয়ী এই মানবাধিকার কর্মী লিখেছেন, ‘কিন্তু আমি জানি, আমরা সবাইকে বাঁচাতে পারবো না।’ এই সঙ্কটে এখনও যারা কোনও ধরনের ধরনের সহায়তা পাননি তাদের জন্য মালালার হৃদয় ফাটছে।
‘আমার হৃদয় তাদের জন্য ভেঙে যাচ্ছে, যাদের নাম আমরা হয়তো ভুলে যাব অথবা কখনো জানবোও না। যাদের সাহায্যের আর্তনাদ থেকে যাবে জবাবহীন।’
নিজের ঘটনার ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের মনোযোগ যে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে সেটি স্বীকার করেছেন মালালা। লিখেছেন, ‘যখন তালেবান আমাকে গুলি করল, তখন পাকিস্তানের এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিকরা আমার নাম জেনে যান।’
মালালা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছ থেকে তিনি যে ধরনের সমর্থন পেয়েছেন সেটি ছাড়া ঘটনা একেবারে ভিন্ন ধরনেরও হতে পারতো।
‘‘মানুষ যদি ‘আমিই মালালা’ ব্যানার না ধরতেন, হাজার হাজার চিঠি ও সহায়তার প্রস্তাব, প্রার্থনা না করতেন এবং সাংবাদিকরা সংবাদ না লিখতেন, তাহলে আমি হয়তো কোনও মেডিকেল সেবাই পেতাম না।’’
মালালা বলেন, ৯ বছর পর আমি এখনও মাত্র একটি বুলেটের ক্ষত থেকে থেকে সেরে উঠছি। গত চার দশকে আফগানিস্তানের মানুষ লাখ লাখ বুলেট সহ্য করেছেন।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ এর দশকে তালেবানরা যখন শরিয়া আইনের কট্টর প্রয়োগের মাধ্যমে আফগানিস্তান শাসন করেছিল তখন সেখানে নারী ও মেয়েদের বেশিরভাগই শিক্ষা এবং চাকরি থেকে বঞ্চিত ছিলেন। গত সপ্তাহেও মালালা তালেবানের এবারের শাসনামলে নারী, সংখ্যালঘু এবং মানবাধিকারের সমর্থকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এসএস