আফগান তালেবানের পুনরুত্থানে কোন পথে চীন?
গত মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর বেশকিছু ছবি দেশটির সরকারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এতে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে অনেকটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তালেবানের সদস্যদের ছবি তুলতে দেখা যায়। তাদের পরনে ছিল ঐতিহ্যবাহী পাগড়ি আর লম্বা পাঞ্জাবি। চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের ভ্রু কুঁচকে দেয় এই ছবি।
তারপর থেকে চীনের প্রচারণা চালানোর কুশীলবরা অনেকটা শান্তভাবে জনগণকে আফগানিস্তানের ক্রমবর্ধমান সম্ভাব্য পরিস্থিতি মেনে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করেন। তারা বলতে থাকেন, দ্রুতগতিতে আফগানিস্তান দখল করায় কট্টরপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী তালেবানকেই হয়তো বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হতে পারে বেইজিংকে।
‘এমনকি তারা যদি পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে, তাহলেও তারা বিবেচনার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হবে’ বলে বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্রনীতি চিন্তাধারার সাথে পরিচিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবশালী এক ভাষ্যকার মন্তব্য করেন। চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম উইচ্যাটে ছদ্মনাম নিউতানকিন বা জিথার-প্লেইং কাউ নামের অ্যাকাউন্ট থেকে এমন মন্তব্য করেন তিনি।
এর আগে, শুক্রবার চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ট্যাবলয়েড গ্লোবাল টাইমস আফগানিস্তানের এক বিরোধী নেতার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে। এতে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অবশ্যই তালেবানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
বেইজিংয়ের অস্বস্তি
মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের ফলে তালেবান যে গতিতে দেশ দখলের তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে তা চীনের জন্য কিছুটা হলেও অস্বস্তিকর। দেশটির পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদকে অস্থিতিশীল শক্তি হিসেবে অভিহিত করে বেইজিং; আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতার ঢেউ লাগতে পারে সেখানেও।
জিনজিয়াংয়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলোকে আশ্রয় দিতে তালেবান নিয়ন্ত্রিত এলাকা ব্যবহৃত হতে পারে বলে বেইজিংয়ের দীর্ঘদিনের উদ্বেগ রয়েছে। তবে চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিও মেনে চলে।
জিনজিয়াংয়ে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে চীন। সেখানকার সীমান্তগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর বিশেষজ্ঞরা জিনজিয়াংয়ের বন্দি শিবিরে কমপক্ষে ১০ লাখ জাতিগত উইঘুর মুসলিমকে আটকে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু চীন বলছে, ইসলামি চরমপন্থী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ নির্মূলে সহায়তার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ স্থাপনায় উইঘুরদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
২০১৯ সালের পর গত মাসে চীনের উত্তরাঞ্চলীয় শহর তিয়ানজিনে তালেবানের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ইসলামপন্থি এই গোষ্ঠী শক্তিশালী হিসেবে হাজির হওয়ায় ওয়াং ই বলেছেন, আফগানিস্তান একটি মধ্যপন্থি ইসলামি নীতি গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা করেন।
তালেবানের প্রতিনিধিদের পাশে দাঁড়ানো ওয়াং ইর একটি ছবি উইবোতে শেয়ার করে চীনা একজন নাগরিক লিখেছেন, ‘এই একই তালেবান কি বিশ্ব গণমাধ্যমের সামনে বৌদ্ধ অধ্যুষিত বামিয়ান শহর গুঁড়িয়ে দেয়নি? আমাদের কি একটি শেষ সীমা থাকা উচিত নয়?’
বাস্তববাদী চীন
ক্রমবর্ধমানভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা চীন এই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে যে, তারা কখনোই যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার মতো তালেবানের সঙ্গে লড়াই করবে না। তালেবানকে মোকাবিলায় চীনের এটি এক ধরনের কৌশলও হতে পারে।
সর্বশেষ তালেবান ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত এবং তার আগে ১৯৯৩ সালে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে দেশটি থেকে কূটনীতিকদের প্রত্যাহার করে নেয় চীন।
সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ লিন মিনওয়াং বলেন, ‘এটাই আমাদের বাস্তববাদী করেছে। আপনি কীভাবে নিজের দেশ চালাবেন তা অনেকাংশে আপনার কাজের ওপর নির্ভর করে। শুধু এটি যেন চীনকে প্রভাবিত না করে।’
তিনি বলেন, ‘যখন চীনের মতো একটি প্রধান এশীয় শক্তি খোলামেলাভাবে বৈঠক করে তালেবানের রাজনৈতিক বৈধতাকে স্বীকৃতি দেয়, তখন এটি তালেবানের বড় ধরনের কূটনৈতিক বিজয়ই।’
চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম চলতি সপ্তাহে অন্তত দুটি বিশ্লেষণাত্মক সংবাদ প্রকাশ করে; যেখানে আফগানিস্তানকে ‘বিদেশি সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান’ অভিহিত করে চীন যাতে ‘গ্রেট গেমের’ খপ্পরে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়। চীন আফগানিস্তানে সেনা পাঠানোর অভিপ্রায়কে প্রশ্রয় দেয় না এবং যুক্তরাষ্ট্রের রেখে যাওয়া শক্তির শূন্যতা পূরণ করতে পারে এমন বিভ্রান্তিকেও পাত্তা দেয় না বলে লিখেছে গ্লোবাল টাইমস।
তালেবানের আশা, চীনের টোপ
ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকের পর তালেবান জানায়, তারা আশা করে আফগানিস্তানে আরও বড় ধরনের অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতে পারে চীন। সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় স্টাডিজের অধ্যাপক ঝ্যাং লি বলেন, এটি পরিষ্কার— যুদ্ধ-পরবর্তী আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিকে টোপ হিসেবে ধরে রাখতে চায় চীন; যাতে উভয় পক্ষকে যুদ্ধ বন্ধ এবং রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাতে উৎসাহিত করা যায়।
গত মাসে পাকিস্তানে একটি বাসে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৯ চীনা শ্রমিকসহ ১৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতায় চীনের ঝুঁকি তুলে ধরেছে পাকিস্তানে চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে চালানো এই হামলা। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়টিভের আওতায় পাকিস্তানে ব্যাপক অবকাঠামো নির্মাণ করছে চীন।
ঝ্যাং বলেছেন, অস্থিতিশীলতা ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়। যে কারণে চীনের এক নম্বর অগ্রাধিকার হচ্ছে যুদ্ধ বন্ধ করা।
এসএস/জেএস