কাবুলে কি ‘সায়গনের’ পুনরাবৃত্তি ঘটছে?
যেভাবে ঝড়ের গতিতে তালেবান আফগানিস্তানের একের পর এক বড় বড় প্রাদেশিক শহর নিজেদের দখলে নিচ্ছে তাতে করে রাজধানী কাবুলের পতনের আশঙ্কায় আতঙ্কিত যুক্তরাষ্ট্র মার্কিনিদের ফেরাতে কাবুলে তিন হাজার সেনা পাঠিয়েছে ওয়াশিংটন।
মার্কিন দূতাবাসের সিংহভাগ কূটনীতিক ও আমেরিকানদের দ্রুত সরিয়ে নিতে এসব সেনা শুক্রবার কাবুলে পৌঁছেছে। এই সৈন্যরা কাবুল বিমানবন্দরে মোতায়েন থাকেবে এবং বিশেষ বিমানে করে মার্কিন নাগরিক এবং কূটনীতিকদের ফিরে আনার কাজে সাহায্য করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদরদফতর পেন্টাগন জানিয়েছে, আরও অতিরিক্ত ৪ হাজার মার্কিন মেরিন সেনা ওই অঞ্চলে যাচ্ছে যাতে পরিস্থিতি বেগতিক হলে তারা দ্রুত তারা আফগানিস্তানে যেতে পারে। গতকাল বৃহস্পতিবার এমন সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ
কাবুল থেকে মার্কিন নাগরিক ও কূটনীতিকদের জরুরিভিত্তিতে ফিরিয়ে আনার এই, পরিকল্পনা ইঙ্গিত করছে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন অনড়। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে মার্কিনদের ফেরানো হচ্ছে।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ‘আফগানিস্তানের উত্তরের বড় বড় শহর যে গতিতে তালেবান কব্জা করছে এবং যেভাবে আফগান সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ছে তাতে বাইডেন প্রশাসন দেশটি থেকে আমেরিকানদের বের করে আনার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
হোয়াইট হাউস ও সামরিক সূত্রের বরাতে শুক্রবার নিউইয়র্ক টাইমস লিখছে আগামী এক মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাইডেনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হবে।
বুধবার রাত এবং বৃহস্পতিবার সকালে দুই দফায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার সিনিয়র জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের সাথে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে পরামর্শ করেন। সেখানে আমেরিকান নাগরিক ছাড়াও যেসব আফগান নাগরিক আমেরিকানদের জন্য কাজ করেছেন এবং প্রাণের ঝুঁকিতে রয়েছে তাদের সরিয়ে আনতে বাড়তি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন বাইডেন।
‘ফ্লাইট পাওয়া মাত্রই’ প্রস্থানের পরামর্শ
কাবুলে মার্কিন দূতাবাস থেকে গত কয়েকদিন ধরে কয়েক দফায় ‘ফ্লাইট পাওয়া মাত্র’ আমেরিকানদের দ্রুত আফগানিস্তান ছাড়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছে। দূতাবাসে ন্যূনতম কূটনীতিকদের রেখে অন্যদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য তাই অতিরিক্ত সেনা পাঠানো হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস শুক্রবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন, কাবুলে মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে। এই সংখ্যা হবে চার হাজারের মত যাদের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ আমেরিকান নাগরিক।
প্রাইস বলেন, ‘তালেবানের সামরিক তৎপরতা যেভাবে বাড়ছে, যেভাবে সহিংসতা এবং অস্থিতিশীলতা আফগানিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তবে আমরা আবারও স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, কাবুলে দূতাবাস বন্ধ হবে না।’
নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে নিউইয়র্ক টাইমস লিখছে, আফগানিস্তান থেকে দূতাবাস কর্মীদের সরিয়ে আনার ব্যবস্থার পাশাপাশি দোহায় তালেবানের কাছ থেকে নিশ্চয়তা চাওয়া হচ্ছে যে, কাবুল দখল করলেও তারা যেন মার্কিন দূতাবাসের ওপর কোনো হামলা না করে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ধারণা আগামী এক মাসের মধ্যেই তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হতে পারে। শুক্রবার আফগানিস্তানের আরও ছয়টি বড় প্রাদেশিক রাজধানীসহ ৩৪টি প্রদেশের মধ্যে গত এক সপ্তাহে ১৮টি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তালেবান।
যুক্তরাজ্যও কাবুলে সৈন্য পাঠাচ্ছে
ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ঘোষণা আসার পরই ব্রিটেও জানিয়েছে, কাবুলে ব্রিটিশ দূতাবাসের কর্মী এবং ব্রিটিশ নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে ৬০০ ব্রিটিশ সেনা কাবুলে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে সব নাগরিককে আফগানিস্তান ত্যাগের কথা বলা হয়।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুর মিলিয়ে ব্রিটিশ সরকারও জোর দিয়ে বলছে. কাবুলে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত স্যার ল্যরি ব্রিসটো ও অল্প কজন কর্মকর্তা আফগানিস্তানে থেকে যাবেন। তবে নিরাপত্তা শঙ্কার কারণে তারা রাজধানী কাবুলের আরও কোনো সুরক্ষিত জায়গায় চলে যাবেন।
‘সায়গন’ থেকে পালানোর সাথে তুলনা
তালেবান যে দ্রুতগতিতে আফগানিস্তান দখল করে নিচ্ছে, তাতে সৈন্য প্রত্যাহারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। ব্রিটিশ মন্ত্রীর মুখে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা বিরল ঘটনা।
মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী রিপাবলিকান সদস্য মিচ ম্যাকোনেল আফগানিস্তান থেকে মার্কিন নাগরিক ও কূটনীতিকদের সরিয়ে আনার সিদ্ধান্তের সাথে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘অপমানজনক প্রত্যাহারের‘ সাথে তুলনা করেছেন।
এক বিবৃতিতে সিনেটে রিপাবলিকান নেতা ম্যাককনেল বলেছেন, ‘নাগরিকদের ফিরিয়ে আনতে সৈন্য পাঠানোর অর্থ হলো সরকার কাবুল পতনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাইডেনের সিদ্ধান্ত ‘১৯৭৫ সালে সায়গন পতনের চেয়েও আরো অপমানজনক পরিণতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষে সায়গনের একটি ভবনের ছাদ থেকে মার্কিন নাগরিক ও আমেরিকানদের ভিয়েতনামী সহযোগীদের হেলিকপ্টারে উঠে পালাবার প্রাণান্তকর চেষ্টার যে ছবি ভিয়েতনামের আমেরিকার পরাজয়ের প্রতীক মনে করা হয় তা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে।
গত বৃহস্পতিবার কাবুল থেকে দূতাবাস কর্মী এবং আমেরিকান নাগরিকদের জরুরিভিত্তিতে সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা আসার সাথে সাথেই সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে অনেক মানুষ সায়গনের ওই ছবি পোস্ট করছেন, শেয়ার করছেন, বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন।
এএস