তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনের চারটি কারণ
মধ্যপ্রাচ্যে ২০১১ সালে আরব বসন্ত নামে যে গণবিক্ষোভ ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন শুরু হয়েছিল- তার সূচনা ছিল তিউনিসিয়াতেই। সেখান থেকে দাবানলের মতই গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আরব বিশ্বের এক বিরাট অংশজুড়ে, আর পরের কয়েক মাসে পতন ঘটেছিল ওই অঞ্চলের কয়েকটি শাসকচক্রের। কিন্তু তার ১০ বছর পর আজ সেই আরব বসন্তের সুতিকাগার তিউনিসিয়া পতিত হয়েছে গুরুতর সংকটে- যদিও সেই পটপরিবর্তনের পরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একমাত্র এই দেশটিই সাফল্য পেয়েছিল বলে মনে করা হয়।
গত ২৫ জুলাই তিউনিসিয়ায় তৈরি হয় এক উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির। প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ এক বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিশেম মেচিচিকে বরখাস্ত করেন, স্থগিত করেন পার্লামেন্ট। এটি ছিল এমন এক পদক্ষেপ যাকে সাইয়েদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ- বিশেষ করে দেশটির ইসলামপন্থিরা এক ‘বিপজ্জনক অভ্যূত্থান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ অবশ্য সংবিধান উদ্ধৃত করে বলছেন, দেশে ব্যাপক গণবিক্ষোভের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাকে কিছু ব্যবস্থা নিতে হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা তারই অংশ।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের উত্তর আফ্রিকা সংক্রান্ত একজন বিশেষজ্ঞ রিকার্ডো ফ্যাবিয়ানি বলছেন, ‘প্রেসিডেন্টের এসব পদক্ষেপ ২০১১ সালের বিপ্লব-পরবর্তীকালে তিউনিসিয়ার সবচেয়ে গুরুতর রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে। ঘটনাপ্রবাহ কোন দিকে যাবে তা অনিশ্চিত এবং প্রেসিডেন্ট সাইয়েদের পদক্ষেপকেও মনে হচ্ছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রার মতো।’
তিউনিসিয়ায় এখন একদিকে চলছে করোনাভাইরাস মহামারির ব্যাপক বিস্তার- আর অন্যদিকে এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক অস্থিরতা এবং গণঅসন্তোষ- সব মিলিয়ে এক নজিরবিহীন সংকটে পড়েছে দেশটি। এর পেছনে যে কারণগুলো কাজ করেছে, তার মধ্যে প্রধান চারটি উল্লেখ করা হলো এখানে।
প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি, আশাভঙ্গের ক্ষোভ
মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও লেখক আকরাম বেলকায়েদ বলছেন, উত্তর আফ্রিকার ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশ তিউনিসিয়া এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও আরব বিশ্বে এ দেশটিকে দেখা হয় গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা হিসেবে।
তার মতে, ‘তিউনিসিয়া হচ্ছে একমাত্র আরব দেশ যাতে একটা স্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র আছে। এখানে অবাধ নির্বাচন হয়, লোকজন জেলে যাবার ভয় ছাড়াই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাতে পারে। এখানকার অন্য দেশগুলোর সাথে তুলনা করলেই এটা বোঝা যায়।’
তিনি বলছেন, তিউনিসিয়ায় আরব বসন্ত-পরবর্তীকালে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি এবং এখানে যে সমস্যা চলছে তার একটা কারণ এটাই। তিউনিসিয়াকে দেখা হয় আরব বসন্তের একমাত্র সাফল্য হিসেবে, কিন্তু এখানে এখনও অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে- যা করা হয়নি।
বেলকায়েদ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ পার্লামেন্ট স্থগিত করা এবং প্রধানমন্ত্রী হিশেম মেচিচিকে বরখাস্ত করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন- তা হয়তো তিউনিসিয়ার অর্জনকে বানচাল করে দিতে পারে। গণতন্ত্রের হাত বাঁকা করার চেষ্টা কখনও ভালো ফল আনে না। আপনি যদি একবার এ কাজ করেন, তাহলে পরে আরও বেশি কিছু করার প্রলোভন তৈরি হয়।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা
প্রধানমন্ত্রী মেচিচিকে বরখাস্ত করা হয়েছিল তিউনিসিয়ার বেশ কিছু শহরে গণবিক্ষোভের পর। এই বিক্ষোভের আগে দেশটিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল। যেটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার তা হলো, এই বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে স্লোগান দিচ্ছিল।
বিবিসির উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক সংবাদদাতা রানা জাওয়াদ বলছেন, ‘অনেকের কাছে মনে হয়েছিল- এক বছর ধরে বিশৃঙ্খলভাবে দেশ পরিচালনার পর এটাই হচ্ছে নতুন আশার আলো। কিন্তু অন্যদের কাছে মনে হয়েছিল যে সাংবিধানিক দিক থেকে এটা হবে অত্যন্ত প্রশ্নসাপেক্ষ এক পদক্ষেপ- যার পরিণতিতে অস্থিতিশীলতা এবং সুদূরপ্রসারী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।’
তা ছাড়া তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক সংকটের মূল অনেক গভীরে। ২০১১ সালের আরব বসন্ত নামের গণবিক্ষোভে দেশটির দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট জিনএল আবিদিন বেন আলি উৎখাত হবার পর থেকে এ পর্যন্ত তিউনিসিয়ায় ৯টি সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং বিদায় নিয়েছে। কোনো কোনো সরকারের আয়ু ছিল মাত্র কয়েক মাস।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ একসময় ছিলেন সাংবিধানিক আইনের একজন অধ্যাপক। প্রেসিডেন্ট হবার আগে তার কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়েছিলেন একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন।
বিবিসি মনিটরিংয়ের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা সংক্রান্ত দুই বিশেষজ্ঞ সামিয়া হোসনি এবং আমিরা ফাতালিয়া বলছেন, তিউনিসিয়ার জনগণের মধ্যে প্রেসিডেন্টের পক্ষে এখনও বেশ ভালো সমর্থন রয়েছে।
তাদের মতে, সাইয়েদ জনগণের বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তিনি ৭২ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন - যাতে দেশের রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্টের ব্যাপারে জনগণের অসন্তোষের প্রতিফলন ঘটেছিল। তিউনিসিয়ার সমাজের তরুণদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট সাইয়েদের পক্ষে বড় সমর্থন আছে।
প্রেসিডেন্ট কাইস সাইয়েদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেচিচিকে নিয়োগ করেছিলেন ২০২০ সালের জুলাই মাসে। মেচিচির পূর্বসুরী এলিয়েস ফাখফাখের ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র পাঁচ মাস।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সংঘাত
নতুন প্রধানমন্ত্রী মেচিচির সাথে প্রেসিডেন্ট সাইয়েদের প্রায়ই মতের অমিণল লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। তিউনিসিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট উভয়েই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকে। ২০১৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে গঠিত হয় একটি কোয়ালিশন সরকার। এসব পার্টি অনেক সময়ই বিভিন্ন নীতিগত প্রশ্নে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিল।
সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ এক ডিক্রি জারি করে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। এর মধ্যে দেশটির স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও বিচারের মত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরাও ছিলেন। এরপর প্রেসিডেন্ট সাইয়েদ তারই নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এই দায়িত্বটি আগে ছিল প্রধানমন্ত্রী মেচিচির হাতে।
পরে তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যে, কেউ যদি জনগণের মধ্যে ‘টাকা ছড়িয়ে’ তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ সংগঠিত করার চেষ্টা করে এবং কেউ সহিংসতার সৃষ্টির কথা ভেবে থাকে- তাহলে সশস্ত্র বাহিনী ‘বুলেট দিয়ে তার জবাব দেবে।’
গবেষক রিকার্ডো ফ্যাবিয়ানি বলছেন, এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের সমর্থক ও তার বিরোধীদের মধ্যে যে সংঘর্ষ হয়েছে- তা ছিল সীমিত আকারের। তবে আগামী কিছু দিনে সংঘর্ষ বেড়ে যাবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা
কোভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই তিউনিসিয়ার অর্থনীতিতে সমস্যা চলছিল। কিন্তু মহামারি শুরু হবার পর তা দেশটির জাতীয় অর্থনীতি এবং ক্ষুদ্র ও স্থানীয় ব্যবসার ওপর গুরুতর আঘাত হিসেবে নেমে আসে। তিউনিসিয়ায় বেকারত্বের হার বেড়ে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব ২০২০ সালের শেষ নাগাদ ৩৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
তিউনিসিয়ার অর্থনীতির একটা অন্যতম প্রধান খাত ছিল পর্যটন। কোভিড-১৯ এর কারণে তাতে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতেও গুরুতর ক্ষতি হয়েছে। এর ফলে ২০২০ সালে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি ৯ শতাংশ সংকুচিত হয়ে গেছে।
আকরাম বেলকায়েদ বলছেন, তিউনিসিয়া একটি দরিদ্র দেশ, তার বিনিয়োগ দরকার। দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন খুবই খারাপ, গত কয়েক মাসে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। অর্থনীতির এই স্থবিরতার প্রভাব হতে পারে গভীর ও সুদূরপ্রসারী।
তার মতে, বিপ্লবের পর থেকে লোকজন কাজ পাবার অপেক্ষায় আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোর ব্যাপারে এখনও কিছুই করা হয়নি।
কোভিড-১৯ মহামারি
কোভিড-১৯ মহামারির ব্যাপারে সরকার যেভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে তা নিয়ে তিউনিসিয়ার মানুষের মধ্যে হতাশা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, পুরো আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে কোভিড মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি তিউনিসিয়ায়।
করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অগ্রগতির ওপর নজর রাখে এমন একটি অনলাইন প্রকাশনা হচ্ছে আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা। তারা বলছে, তিউনিসিয়ার ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশেরও কম লোককে এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে তিউনিসিয়ায় কোভিডে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নিসাফ বেন আলায়া বলছেন, আমরা এখন চরম বিপর্যয়ের মধ্যে আছি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, হাসপাতালে একটা বেড পেতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য অক্সিজেনের যোগান দিতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন, ডাক্তাররা কাজ করে যাচ্ছেন চরম ক্লান্তি ও মানসিক অবসাদ নিয়ে।
টিএম