মিয়ানমারে এবার জান্তার লক্ষ্যবস্তুতে চিকিৎসকরা
মিয়ানমারে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা, কিন্তু এর মধ্যেই দেশটির চিকিৎসকদের গ্রেফতার করে চলছে ক্ষমতাসীন জান্তা। এ বিষয়ে জান্তার অভিযোগ, গ্রেফতার চিকিৎসকরা দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছেন।
দেশটির রাজনৈতিক কারাবন্দিদের সহায়তা দানকারী সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স জানিয়েছে, সম্প্রতি মিয়ানমারের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর অভিযোগ তোলা হয়েছে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এবং এই অভিযোগে ইতোমধ্যে দেশজুড়ে ৭৩ জন চিকিৎসকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতার এই চিকিৎসকরা সবাই দেশটির বৃহত্তম শহর ও বানিজ্যিক কেন্দ্র ইয়াঙ্গুন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের এবং তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে মিয়ানমারে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।
এদিকে, মিয়ানমারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার জন এবং মারা গেছেন ২৮৬ জন, যা এখন পর্যন্ত মিয়ানমারে একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণের রেকর্ড।
তবে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও মৃতদেহ সৎকারকর্মীরা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি তথ্যের চেয়ে অন্তত কয়েকগুণ বেশি।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে হটিয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, বন্দি করা হয় দেশের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সুচিসহ তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির বিভিন্ন স্তরের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থককে।
অভ্যুত্থানের পরপরই প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি জনতা। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় দেশটিতে। রাজনৈতিক কর্মী-ছাত্র-সাধারণ জনতার পাশাপাশি সেই বিক্ষোভে অংশ নেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীও সেই বিক্ষোভে অংশ নেন।
মিয়ানমারে সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে; প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন মারাও যাচ্ছেন বহু সংখ্যক। কিন্তু ক্ষমতাসীন জান্তা এখনও এ রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
অনেক রোগী করোনায় আক্রান্ত বা এ রোগের উপসর্গে ভুগলেও চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যাচ্ছেন না এই বিশ্বাস থেকে-সামরিক সরকারের অধীনে হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা পাওয়া যাবে না।
তাদের এই বিশ্বাস অনেকটা সঠিক বলেই দেখা যাচ্ছে বাস্তব ক্ষেত্রে। কারণ, মিয়ানমারের হাসপাতালসমূহে ইতোমধ্যে শয্যা সংকট ও মেডিকেল অক্সিজেন চিকিৎসা উপকরণের সংকট তীব্র হয়ে উঠছে বলে দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হচ্ছে।
একাধিক স্বাস্থ্যকর্মী বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, সরকারকারিভাবে এই হাসপাতালসমূহের শয্যা সংকটের সমাধান বা মেডিকেল অক্সিজেন ও ওষুধের সরবরাহ তো আসছেই না, উপরন্তু বিভিন্ন সময় হাসপাতালসমূহে অভিযান চালানোর নামে হাসপাতালসমূহের মেডিকেল অক্সিজেন ও ওষুধপত্র নিয়ে যাচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেছিলেন মিয়ানমারের আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা। করোনার উপসর্গ দেখা দিলে কী করতে হবে, কোন ওষুধ গ্রহণ করতে হবে, কোন সময় অক্সিজেন দিতে হবে ইত্যাদি যাবতীয় পরামর্শ মোবাইল বা টেলিফোনে সাধরণ জনগণকে দিচ্ছিলেন তারা।
একজন চিকিৎসক এ বিষয়ে রয়টার্সকে জানান, প্রতিদিন হাজার হাজার রোগীকে টেলিমেডিসিন সেবা দিচ্ছেন তারা।
সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের এক নেতা এ প্রসঙ্গে বলেন বলেন, ‘চিকিৎসকদের গ্রেফতারে এই ব্যাপারটিকেই পুঁজি করেছে জান্তা। তারা বলছে, স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎকরা করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া সংবাদ ছড়াচ্ছে।’
এদিকে, গত সপ্তাহে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের এক মুখপাত্র মহামারি উত্তরণে দেশের জনগণকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কয়েকজন চিকিৎসক রয়টার্সকে বলেছেন, চিকিৎসকদের গ্রেফতারের মাধ্যমে জনগণকে সরকারের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভর করার কৌশল নিয়েছে জান্তা।
এ বিষয়ে মন্তব্য চেয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। ওই মুখপাত্র গ্রেফতারের বিষয়টি স্বীকার করে রয়টার্সকে বলেন, ‘তারা করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া সংবাদ ছড়াচ্ছিল এবং টেলিমিডিসিন সেবার নামে আক্রান্ত রোগীর আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছিল।’
মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াঙ্গি লি রয়টার্সকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জান্তা তার ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে কোভিডকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।’
সূত্র : রয়টার্স
এসএমডব্লিউ