পেগাসাস নজরদারির তালিকায় রাহুল গান্ধীও
ইসরায়েলে তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিকদের ফোনে নজরদারি চালানোর যে চাঞ্চল্যকর তালিকা ফাঁস হয়েছে; সেই তালিকায় আছেন ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী, বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী অশ্বিনী বিষ্ণু এবং নির্বাচনী কৌশলী প্রশান্ত কিশোরও। ভারতের ক্ষমতাসীন নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন সরকার পেগাসাসের মাধ্যমে বিরোধী দলীয় রাজনীতিক ছাড়াও দেশটির আরও অন্তত ৪০ সাংবাদিকের ফোনেও আড়িপাতা হয়েছে অথবা আড়িপাতার চেষ্টা করা হয়েছে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলেছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রধান বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীকে সম্ভাব্য নজরদারির জন্য অন্তত দু’বার নিশানা করা হয়েছিল। ফাঁস হয়ে যাওয়া ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের তালিকায় রাহুল গান্ধীর নম্বরও পাওয়া গেছে।
ওই তালিকায় নরেন্দ্র মোদির সরকারের দুই মন্ত্রী, বিরোধী তিন নেতা, সাংবিধানিক পদে আসীন এক ব্যক্তি, ৪০ জন সাংবাদিক, অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি থেকে শুরু করে সমাজকর্মী, সরকারি আমলা, আইনজীবী এবং সরকারের সমালোচকের নামও এসেছে। গত লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতে তিন শতাধিক ফোনে আড়িপাতার চেষ্টা চালিয়েছিল দেশটির সরকার ।
গার্ডিয়ান বলছে, ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে রাহুল গান্ধীর দুটি ফোন নম্বর সম্ভাব্য নজরদারির তালিকায় নেওয়া হয়। এই তালিকায় রাহুল গান্ধীর পাঁচজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর নামও এসেছে; যারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। এছাড়া এই তালিকায় ভারতের অন্যতম নির্বাচনী কৌশলী প্রশান্ত কিশোর, তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়সহ ভারতের নতুন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আশ্বিনী বিষ্ণুর নামও আছে।
তবে ফরেনসিক পরীক্ষা ছাড়া তাদের ফোন হ্যাক করার চেষ্টা সফল হয়েছিল কি-না তা এখনই বলা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে গার্ডিয়ান। ব্রিটিশ এই দৈনিক বলছে, ভারতীয় ১০টি নম্বরের সাথে সংযুক্ত ফোন এবং সারা বিশ্বের আরও ২৭টি ফোনে পেগাসাসের মাধ্যমে নজরদারি চালানোর তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
নজরদারি এড়ানোর জন্য রাহুল গান্ধী কয়েক মাস পরপরই তার ফোন পাল্টান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সেই সময় রাহুল গান্ধী তার ফোনটি পেগাসাস প্রজেক্টের কাছে জমা দিতে পারেননি।
এদিকে, বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টিকারী পেগাসাস প্রজেক্ট বিশ্ব গণমাধ্যমে আসার পর সোমবার শুরু হওয়া ভারতের পার্লামেন্ট অধিবেশনে সরকারের তুমুল সমালোচনা করেছেন দেশটির বিরোধী দলীয় নেতারা। তারা এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকারের ব্যাখ্যাও দাবি করেছেন।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা প্রযুক্তি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের উদ্ভাবিত সফটওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী সরকারসমূহ এই নজরদারি চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের হাতে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি ডেটাবেইস পৌঁছেছে, যেখানে ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের একটি তালিকা রয়েছে।
বিশ্বের প্রথম সারির মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী ও রাজনীতিবিদদের ফোন নম্বর এগুলো। তালিকা হাতে পাওয়ার পর গার্ডিয়ান, দ্য ওয়্যারসহ ১৬টি পত্রিকাকে এই তথ্য জানায় ফরবিডেন স্টোরিজ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
পেগাসাস কী
ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে এই স্পাইওয়্যার সফটওয়্যার তৈরি করেছে, যা আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর মেসেজ, ছবি, ইমেইল পাচার করতে যেমন সক্ষম, তেমনি কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোন চালুও রাখতে পারে।
২০১৬ সালে এনএসও গ্রুপ এই সফটওয়্যার প্রথম প্রস্তুত করে, তবে তখন তার নাম ছিল কিউ সুইট, পরে তা পরিবর্তন করে নাম দেওয়া হয় ট্রাইডেন্ট এবং তারও পরে নামকরণ হয় পেগাসাস।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি গার্ডিয়ানকে বলেন, “যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তাহলে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে।
‘ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে।”
২০১৯ সাল থেকে সীমিত পরিসরে এই সফটওয়্যার বিক্রি শুরু করে এনওএস গ্রুপ। প্রাথমিক অবস্থায় বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল এর প্রধান ক্রেতা। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বৈধ লাইসেন্সের মাধ্যমে ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জানিয়েছে, বর্তমান বিশ্বে অত্যাধুনিক স্পাইওয়্যার সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে পেগাসাসকে সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করা হয়।
পেগাসাস প্রজেক্ট
গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ফাঁস হওয়া ডেটাবেইসে ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকরা এদের বিষয়ে তৎপর ছিল এবং ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ দৃঢ়ভাবে মনে করে যে এনএসওর গ্রাহক সরকারগুলোর লক্ষ্যবস্তু ছিল ওই নম্বরগুলো।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে নজরদারির মুখে থাকা এই ব্যক্তিদের মধ্যে কারা কারা রয়েছে, তাদের নাম অচিরেই প্রকাশ করবে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’।
এই ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, বিরোধী রাজনীতিক ছাড়াও ব্যবসায়ী, ধর্মীয় নেতা, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ফোন নম্বরও রয়েছে।
কোনো কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের ফোন নম্বরও থাকার কথা জানিয়ে গার্ডিয়ান লিখেছে, ক্ষমতাবানরা তাদের স্বজনদের উপরও গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
রোববার এই তালিকা প্রকাশ শুরুর পর ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সিএনএন, রয়টার্স, নিউ ইয়রক টাইমস, এপি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিক রয়েছে।
৪৫টি দেশের ফোন নম্বর পাওয়া গেছে ওই তালিকায়, তার মধ্যে ১ হাজারের বেশি নম্বর ইউরোপের দেশসমূহের।
পেগাসাসের ক্রেতা কারা?
কোন কোন দেশের সরকার পেগাসাস কিনেছে, গোপনীয়তার শর্তের অজুহাতে সে তথ্য এনএসও প্রকাশ করেনি। তবে সিটিজেন ল্যাবের গবেষণায় অন্তত ৪৫টি দেশে পেগাসাসাস ছড়ানোর প্রমাণ মিলেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
দেশগুলো হল: আলজেরিয়া, বাহরাইন, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, মিশর, ফ্রান্স, গ্রিস, ভারত, ইরাক, ইসরায়েল, আইভরি কোস্ট, জর্ডান, কাজাখস্তান, কেনিয়া, কুয়েত, কিরগিজস্তান, লাটভিয়া, লেবানন, লিবিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নেদারল্যান্ডস, ওমান, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন অঞ্চল, পোল্যান্ড, কাতার, রুয়ান্ডা, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইজারল্যান্ড, তাজিকিস্তান, থাইল্যান্ড, টোগো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, উগান্ডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, উজবেকিস্তান, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া।
দ্য ওয়্যার জানিয়েছে, ভারতের ৩০০টি নম্বরের মধ্যে ৪০ জন সাংবাদিক, বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা, এক বিচারপতি, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন সংস্থার সাবেক ও বর্তমান ব্যক্তিদের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী সরকারের দুই মন্ত্রীর নম্বরও রয়েছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে ওয়্যার জানিয়েছে, এই নম্বরগুলো ২০১৮ ও ২০১৯ সালে আড়িপাতার লক্ষ্যবস্তু ছিল। ২০১৯ সালেই ভারতে লোকসভা নির্বাচন হয়েছিল।
পেগাসাস কেলেঙ্কারি নিয়ে শোরগোল ওঠায় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতির খবর এসেছে টাইমস অব ইন্ডিয়ায়।
তাতে দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন থাকার কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যে ধরনের খবর এসেছে, তা ভিত্তিহীন। নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ফোনে আড়িপাতার যে অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে করা হচ্ছে, তার কোনো ভিত্তি নেই।
বেআইনিভাবে কোনো ফোনে আড়ি পাতা হয় না দাবি করে ভারত সরকার বলেছে, দেশের স্বার্থে যদি সরকারি কোনো সংস্থার আড়ি পাততেই হয়, তবে তারও সুস্পষ্ট নিয়ম রয়েছে, যা অনুসরণ করা হয়।
দ্য ওয়্যার বলেছে, আড়ি পাতার অভিযোগ অস্বীকার করলেও ইসরাইলি পেগাসাস সফটওয়্যার কেনার বিষয়টি সরাসরি নাকচ করেনি ভারত সরকার।
এসএস