ভারতের মুসলমানদের জন্য রমজান মাস হলো ভয়ের সময়

পবিত্র রমজান মাস বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের জন্য শান্তির সময় হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু “বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র” হিসেবে পরিচিত ভারতে মুসলমানদের জন্য এই মাসটি এক ভিন্ন বাস্তবতা নিয়ে আসে।
বিজ্ঞাপন
আজানের পাশাপাশি জনতার চিৎকার, বুলডোজার এবং জানাজার শব্দ শোনা যায়। কোথাও আবার আরেক মুসলিমকে গ্রেপ্তার, মারধর বা হত্যা করা হচ্ছে। মসজিদের গেটে ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি বাড়িও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
কোথাও না কোথাও আবার এমন খবর প্রকাশিত হবে যেখানে মুসলিমদের জোর করে হিন্দু জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, অথবা ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) একজন রাজনীতিবিদ ইসলামের অনুসারীদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য করছেন অথবা ইফতার মাহফিলে আক্রমণ করা হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
— Middle East Eye (@MiddleEastEye) March 28, 2025
ভারতে মুসলিমদের অস্তিত্বকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসবের প্রমাণ খুঁজতে হবে না বা প্রমাণের জন্য ফোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রোলও করতে হবে না। এই ধরনের উদাহরণগুলো দ্রুতই খুঁজে পাওয়া যাবে। যেমন— ইনস্টাগ্রাম রিলে, ভাইরাল কোনও ক্লিপে, অথবা এমন কোনও শিরোনাম যা খুব কমই ট্রেন্ড করে বা রাজনৈতিক বক্তৃতার ছদ্মবেশে দেওয়া কোনও উস্কানি।
বিজ্ঞাপন
একটা সময় ছিল যখন এই ধরনের ঘটনাগুলো সবাইকেই হতবাক করতো— যখন এসব ঘটনা ক্ষোভ, বিতর্ক, অথবা অন্তত রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজের কাছ থেকে কিছুটা প্রতিক্রিয়ারও জন্ম দিতো। কিন্তু এখন এগুলো খুব কমই খেয়াল করা হয়।
সহিংসতা এতটাই নিয়মিত আর এতো প্রত্যাশিত যে— যেন এটি পটভূমির কোনও শব্দে পরিণত হয়েছে; যেন জীবনের একটি বাস্তবতা। আর সেটিও স্পষ্ট সতর্কীকরণের সাথে আসে। আর তা হলো: চুপ থাকো, লুকিয়ে থাকো অথবা শাস্তি পাও।
এই বছর পবিত্র রমজান ও হিন্দুদের হোলি উৎসব একসাথে উদযাপিত হয়েছে। এবং ভারতের বিভিন্ন শহরে হোলির মিছিলকে মুসলমানদের হয়রানির অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করেছে হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো। আমরা এর আগেও এই ধরণটি দেখেছি: “উদযাপন” হিসেবে যা শুরু হয় তা দ্রুত সমন্বিত জনতার সহিংসতায় পরিণত হয়।
ভুক্তভোগীদেরই অপরাধী ঘোষণা
এই মাসে একজন মুঘল সম্রাটের সমাধি ভেঙে ফেলার দাবিতে মহারাষ্ট্রের নাগপুর শহরে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে পুলিশসহ কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়। শেষ পর্যন্ত ৫০ জনেরও বেশি লোকের নামে মামলা করা হয়, যাদের সকলেই মুসলিম।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ছদ্মবেশে আসলে তাদের এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। আর যারা সহিংসতা উস্কে দিয়েছিল তারা কোনও ধরনের শাস্তি পাওয়া থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। এখন এভাবেই কাজ করা হয়: সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ভুক্তভোগীদের অপরাধী ঘোষণা করা হয়।
হোলির সময় মসজিদগুলোতে রঙিন পাউডার ছুঁড়ে মারতে এবং মুসলিম বিরোধী স্লোগান দিতে দেখা গেছে এমন ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। আলীগড় শহরে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মসজিদগুলোকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেয় — যা মূলত রাষ্ট্র-নির্দেশিত “ভেতরে থাকুন” আদেশ। উত্তর প্রদেশের অন্যান্য অংশেও একই ঘটনা ঘটেছে, যেন জনসাধারণের জন্য বিদ্যমান মুসলিম স্থানগুলোতে আক্রমণের জন্য কোনও খোলাখুলি আমন্ত্রণ।
আরও পড়ুন
উত্তরপ্রদেশের সম্ভালে পুলিশ আরও স্পষ্ট করে বলেছে: যদি মুসলিমরা হোলির ঐতিহ্যের অংশ রঙিন পাউডার দিয়ে নিজেদের মাখাতে না চায়, তাহলে তাদের কেবল ঘরের ভেতরে থাকা উচিত। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যখন এই বক্তব্যের পক্ষে ছিলেন, তখন বার্তাটিও বেশ স্পষ্ট ছিল: ভেতরে থাকুন। অদৃশ্য থাকুন। নিজেকে ছোট করুন। শেষমেষ অস্তিত্ব হারান।
কিন্তু দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়াটাও যথেষ্ট নয়। গুজরাটে তারাবির নামাজের পরে সংঘটিত হামলার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলার জন্য এই মাসের শুরুতে একজন মুসলিম ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ভারতে এখন এটাই নিয়ম: মুসলমানদের সহ্য করতে হবে, কিন্তু কখনও প্রতিবাদ করতে পারবে না; কষ্ট ভোগ করতে হবে, কিন্তু কখনও অভিযোগ করতে হবে না।
এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিজেপি নেতারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের উপহাস এবং অবমাননা করবেন, আবার তারা দায়মুক্তিও পাবেন। উত্তর প্রদেশের বিজেপি নেতা রঘুরাজ সিং পরামর্শ দিয়েছেন, হোলির সময় অস্বস্তি এড়াতে মুসলিম পুরুষরা ত্রিপলের মতো করে শরীরে আবরণ পরুন।
এই ধরনের উপহাস মূলত ইচ্ছাকৃত, অমানবিক ইঙ্গিতও ইচ্ছাকৃত। এটি কেবল ধর্মীয় উত্তেজনা সম্পর্কে নয়; এটি আসলে ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রণ এবং জনজীবন থেকে মুসলমানদের মুছে ফেলার একটি নিরলস প্রচেষ্টা।
বিশ্ব কেবলই অসহায়
সম্ভল, নাগপুর বা অন্য যে কোনও জায়গায়, সবসময় ঘটনার ধরণ একই। যখন সহিংসতা শুরু হয়, তখন দোষ চাপানো হয় ভুক্তভোগীদের ওপর। যখন মুসলমানরা প্রতিবাদ করে, তখন তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। যখন তারা চুপ থাকে, তখন তা সম্মতি হিসেবে ধরা হয়।
আর যখন তারা মারা যায়? পৃথিবী তখন অসহায়তা প্রকাশ করে এবং অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকে। সবসময়, ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা ইসলাম-বিদ্বেষের আগুন জ্বালাতে থাকে, স্পষ্ট করে দেয় যে— যারা মুসলমানদের হয়রানি, আক্রমণ বা হত্যা করে তাদের কোনও পরিণতি হবে না। আছে কেবল পুরষ্কার।
আরও পড়ুন
এমন একটি দেশে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠা ক্লান্তিকর যে দেশ কিনা মুসলমানদের অস্তিত্বকে উস্কানি হিসেবে বিবেচনা করে; যে কোনও মুহূর্তে মুসলমানদের মসজিদে আক্রমণ করা হতে পারে, মুসলমানদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, মুসল্লিদের নামাজকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতে পারে। এমনকি রমজানের রোজাও নীরব প্রতিরোধের একটি পদক্ষেপে পরিণত হয়েছে।
এই সবকিছুর স্বাভাবিকীকরণ সবচেয়ে খারাপ অংশ। এটি আর খুব কমই ক্ষোভের জন্ম দেয়, কারণ প্রতিটি ঘটনা পরবর্তী ঘটনায় যেন মিলিয়ে যায়। একটা সময় ছিল যখন উন্মত্ত জনতা মসজিদে হামলা চালালে সবাই হতবাক হতো, নির্যাতনের শিকার মুসলিমদের পুলিশ গ্রেপ্তার করা নিয়েও বিতর্ক চলতো। এখন এগুলো স্বাভাবিক, কেবলই আরেকটি দিন। কোনও ঘটনা ঘটলে মুসলিমরা সংবাদমাধ্যমে একটি ছোট শিরোনাম পায়, সম্ভবত কোনও ভিডিও ভাইরাল হলো এবং তারপর আবারও নীরবতা।
এমনকি ন্যায়বিচারের ধারণাও বদলে গেছে। এটি কেবল হিন্দু জাতীয়তাবাদী জনতাকে জবাবদিহি করতে রাষ্ট্রের অস্বীকৃতির বিষয় নয়, বরং যারা কথা বলে তাদের সক্রিয়ভাবে শাস্তি দেওয়ার বিষয়টিও।
কোনও ঘটনায় মুসলিমরা দুবার ভুক্তভোগী হয়: প্রথমে জনতার হাতে, তারপর পুলিশ, আদালত এবং সরকারের হাতে। যখন একজন মুসলিম পুরুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, তখন পুলিশ তার পরিবারকে টার্গেট করে। যখন কোনও মুসলিম নারী মুখ খোলেন, তখন তাকে হয়রানি করা হয়, যৌন নির্যাতন করা হয় এবং ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়।
শ্বাসরুদ্ধকর নিষ্ঠুরতা
এটিই ভারতে মুসলিমদের দৈনন্দিন বাস্তবতা। এটি এখন আর বড় ধরনের সহিংসতার মুহূর্ত নয়। হিজাব পরার জন্য মুসলিম শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হয়; “হিন্দু এলাকায়” মুসলিম রাস্তার বিক্রেতাদের তাদের জিনিসপত্র বিক্রি করার জন্য মারধর করা হয়; মুসলমানদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করা হয়, বাড়ি থেকে বঞ্চিত করা হয়, পাড়া থেকে বের করে দেওয়া হয়।
এটি কেবল ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং দাঙ্গার ঘটনায় ঘটে, এমনটি নয়। এগুলো ছোট ছোট, অবিরাম নানা উপায়ে জীবনকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলার বিষয়। এটি এক শ্বাসরোধী নিষ্ঠুরতা, যা মুসলমানদের অস্তিত্বের মধ্যে প্রবেশ করে, রমজান মাসে হোক বা হোক সেটা বছরের অন্য যেকোনও সময়।
জনসাধারণের উদাসীনতাও বিস্ময়কর। ভারতকে মুসলিমদের দুর্ভোগকে স্বাভাবিক, প্রত্যাশিত, এমনকি প্রাপ্য হিসেবে দেখার জন্য তৈরি করা হয়েছে। মিডিয়াও তার ভূমিকা “খুব ভালোভাবে” পালন করে। সংবাদমাধ্যমগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে উস্কে দেয়, বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয় এবং রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিটি ঘটনাকে ন্যায্যতা বা বৈধতা দেয়।
ন্যায়বিচার এখন ক্ষমতার পক্ষেই কাজ করে এবং দুর্বলদের রক্ষা করার জন্য যাদের তৈরি করা হয়েছে তারা তাদের মুখ ফিরিয়ে নেয়, অথবা আরও খারাপভাবে, অত্যাচারীদের পক্ষে যোগ দেয়। জনসাধারণ এসব কিছু দেখে, পাশ কাটিয়ে চলে যায় এবং সময়ের সাথে সাথে সামনে এগিয়ে যায়।
রোজার সময় মুসলমানরা ভোর হওয়ার আগে ঘুম থেকে উঠে সেহেরি খায়। এমনকি এটা জেনেও যে— কোথাও, কেউ আমাদের এখানে থাকার বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত। আমরা নামাজ পড়ি, এটা জেনেও যে— মসজিদে নামাজের জন্য জড়ো হওয়াও এখন অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
আরও পড়ুন
আমরা সারাদিন রোজা রেখে ইফতার করি, এটা জেনে যে— আমাদের বাড়ির বাইরেই কেউ অপমান বা পরবর্তী আক্রমণের পরিকল্পনা করতে পারে। মূলত ভারতের মুসলমানরা যাতে কখনও তাদের জায়গা ভুলে না যায় তা নিশ্চিত করার পরবর্তী উপায় হিসেবেই কেউ এই পরিকল্পনা করছে।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই না। এবং আমরা অদৃশ্য হয়ে যাই না, সেটা তারা যতই চায় না কেন। আমরা অস্তিত্বের টিকিয়ে রাখার অনুমতিও চাইছি না। আমরা ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি না। আমরা এখানে আছি — রোজা রাখছি, নামাজ পড়ছি, বেঁচে আছি। এবং এগুলোই প্রকাশ্য প্রতিরোধ।
মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডলইস্ট আই পত্রিকায় এই মতামত-প্রবন্ধটি লিখেছেন নাবিয়া খান। তিনি একজন কবি ও গবেষক এবং ভারতে বসবাস করছেন।
টিএম