এশিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে অস্ত্রসজ্জায় প্রস্তুত ইউরোপ?

ইউরোপ এখন নিজ মহাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে এশিয়ার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ইউরোপের নানা উদ্যোগ হুমকিতে পড়তে পারে। কয়েক বছর আগে ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইইউ ‘ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চায়।’
বিজ্ঞাপন
এখন সেই প্রতিশ্রুতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ইউরোপ দীর্ঘকাল পর আবার নিজেদের সমরাস্ত্রে সজ্জিত করার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে চলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোতে মার্কিন অংশগ্রহণ কমানোর কথা বলছেন।
এর ফলে ইউরোপে মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ন্যাটোতে মার্কিন ভূমিকা কমলে ইউক্রেনে অনিশ্চিত যুদ্ধবিরতি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের তৈরি অন্যান্য সম্ভাব্য সংঘাত ঠেকানোর দায়িত্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকেই এককভাবে বহন করতে হতে পারে।
বিজ্ঞাপন
ইউরোপীয় কমিশন ৪ মার্চ ‘রিআর্ম ইউরোপ’ কর্মসূচি চালুর ঘোষণা দেয়। উরসুলা ভন ডার লিয়েন বলেন, ‘‘আমরা পুনরাস্ত্রসজ্জার যুগে রয়েছি। ‘রিআর্ম ইউরোপ’ বা ইউরোপের পুনরায় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা কর্মসূচির লক্ষ্য আগামী চার বছরে প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ইউরো সংগ্রহ করা।’’
• ইইউয়ের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল
বিজ্ঞাপন
ইউরোপের পুনরায় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার পরিকল্পনা মহাদেশটির প্রতিবেশীদের মধ্যেই আপাতত দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তৈরি করা হয়েছে। ফলে এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য ইইউয়ের সমর্থন উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেতে পারে।
২০২১ সাল থেকে বেশিরভাগ বৃহৎ ইউরোপীয় রাষ্ট্র ‘ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল’ গ্রহণ করেছে এবং এই অঞ্চলে আন্তর্জাতিক নিয়ম-ভিত্তিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে।
ইইউর তৎকালীন পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেল নভেম্বরে লিখেছিলেন, ‘‘বাণিজ্য এবং বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের দৃঢ় সংযোগের কারণে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যা ঘটে তার সরাসরি প্রভাব ইউরোপে পড়ে।’’
জার্মানি এবং আরও বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে কয়েক দশক ধরে চীনের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম।
গত বছর থেকে চীনের সঙ্গে ফিলিপাইনের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফিলিপাইনও ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনের সামরিক ঘাঁটিতে ফরাসি সৈন্যদের প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য একটি ভিজিটিং ফোর্স চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে ফ্রান্স। দেশটির পরমাণু শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী শার্ল দ্য গল কয়েক সপ্তাহ আগে প্রথমবারের মতো ফিলিপিনো বাহিনীর সঙ্গে যৌথ যুদ্ধ মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক জলপথে চীনের দাবির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যান্ডস এবং যুক্তরাজ্যের যুদ্ধজাহাজ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে ‘নৌচলাচলের স্বাধীনতা’ মিশনে মহড়ায় অংশ নিয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থনে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের অধ্যাপক জাচারি আবুজা বলেছেন, ন্যাটোর প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের দুর্বল সমর্থনের কারণে ইউরোপীয়রা কিয়েভকে সমর্থন এবং ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে আরও বেশি মনোযোগী হবে।
তিনি বলেন, ‘‘এশিয়ার নিরাপত্তাকে সমর্থন করার পাশাপাশি ইউরোপীয়দের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো সক্ষমতা নেই।’’
• সবার আগে ইউরোপ?
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো অতি দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খুব কম ইউরোপীয় নেতাই বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এর প্রভাব সম্পর্কে চিন্তা করার সময় পেয়েছেন।
বিশ্লেষকরাও এই ইস্যুতে বিভক্ত। তবে সাধারণ ধারণা হল, ইউরোপের সক্ষমতা বাড়লেও, ‘সবার আগে ইউরোপ’ কৌশলের অর্থ এশীয় অংশীদারদের পরিত্যাগ করা নয়।
আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ ফেলো ইয়ান স্টোরি মনে করেন, যেহেতু নিরাপত্তা ইস্যুতে ইউরোপের উদ্বেগগুলো মূলত স্থলভিত্তিক এবং এশিয়ার নিরাপত্তা সংকটগুলো মূলত সমুদ্র কেন্দ্রিক। ফলে তিনি মনে করেন, কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্র সম্ভবত বছরে কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ এবং সম্ভব হলে বছরে একটি বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ পাঠানোর সামর্থ্য রাখতে পারে।
তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপের সামরিক উপস্থিতি সবসময়ই মূলত প্রতীকী ছিল। তবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো তাদের ইউরোপীয় অংশীদারদের কাছ থেকে এই অঞ্চলের প্রতিশ্রুত সহযোগিতার ব্যত্যয়কে স্বাগত জানাবে না।’’
ফিলিপাইনের পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক জোশুয়া এসপেনা মনে করেন, ইউরোপের পুনর্সশস্ত্রীকরণে এশিয়ার দেশগুলোর জন্যও কিছু ইতিবাচক বিষয় থাকতে পারে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানি বাড়াতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এসপেনা তাইওয়ান থেকে উন্নত মাইক্রোচিপ এবং ফিলিপাইন থেকে নিকেল এবং তামা আমদানির কথা তুলে ধরেছেন।
যদি ইউরোপ অস্ত্র উৎপাদন উল্লেখযোগ্যহারে বাড়ায়, তাহলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে ইউরোপীয় অস্ত্র রপ্তানি বৃদ্ধির সক্ষমতা আরও বেশি হতে পারে। এসব দেশের অনেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়ার বাইরে গিয়ে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র ও সরঞ্জামে বৈচিত্র্য আনতে মরিয়া।
• অর্থনৈতিক সংকট
বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে একমত যে ইউরোপের পুনর্নির্মাণ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
থাইল্যান্ডের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) আলোচনা নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ইইউ। চলতি বছরেই এ সংক্রান্ত চুক্তি সই হতে পারে। ১২ বছর বিরতির পর জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা আবার শুরু হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ভন ডার লিয়েন বলেছিলেন, ইইউ এবং ভারতও এই বছর একটি এফটিএ চূড়ান্ত করার আশা করছে।
তবে যুক্তরাজ্য প্রতিরক্ষা ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়ার কয়েকদিন পর লন্ডন জানিয়েছে, দেশটি ২০২৭ সালে তাদের বৈদেশিক সাহায্য বাজেট মোট জাতীয় আয়ের শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক তিন শতাংশ করবে।
ফ্রান্স এই বছরের শুরুতে বৈদেশিক উন্নয়ন ৩৫ শতাংশ কমিয়েছে। নেদারল্যান্ডসও ‘সবার আগে নেদারল্যান্ডসের স্বার্থ’ ঘোষণার অংশ হিসাবে এই নীতিই অনুসরণ করবে।
আইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের আসিয়ান স্টাডিজ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ ফেলো জোয়ান লিন ওয়েইলিং বলেন, ‘‘যদি ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকারগুলো তাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশীদের ওপরই ক্রমবর্ধমানভাবে কেন্দ্রীভূত হয়, তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় (আর্থিক) প্রতিশ্রুতি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নাও হতে পারে।’’
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বৈদেশিক সাহায্যে ইউরোপের প্রতিশ্রুতিতে কাটছাঁট করা হলে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দাতব্য ও মানবিক সংস্থাগুলোও সেটার প্রভাব খুব বেশি তাৎক্ষণিকভাবে টের পাবে না। তারা মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসন মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডিকে ধ্বংস করার ফলে এর চেয়ে বড় প্রভাব এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী পড়েছে।
বরং ওয়াশিংটন বৈদেশিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী তৈরি হওয়া আর্থিক ও প্রশাসনিক শূন্যস্থান পূরণে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় রাষ্ট্র দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার একটি বৃহৎ বহুজাতিক পরিবেশ প্রকল্প ‘জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন পার্টনারশিপের’ নেতৃত্বে ছিল যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানি চলতি মাসেই নিশ্চিত করেছে, মার্কিন সহায়তা না এলে জার্মানিই সেই ভূমিকা গ্রহণ করবে।
পরিবেশ-সম্পর্কিত তহবিলের ওপর এর প্রভাব পড়তে পারে। তবে যেকোনো নীতি কার্যকর হতেও বেশ কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। ইউনিভার্সিটি মালয়ার পরিবেশগত রাজনীতির সহযোগী অধ্যাপক হেলেনা ভার্ককি বলেছেন, ‘‘এরইমধ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া তহবিলগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়।’’
এসএস