বিমান ছিনতাই করে পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে বেলারুশ
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটকে রোববার যাত্রাপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য করার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। গ্রিস থেকে লিথুয়ানিয়াগামী রায়ানএয়ারের এই ফ্লাইটটিতে বেলারুশের একজন ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক ছিলেন।
এই ঘটনার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া কী হবে তা ঠিক করতে ইউরোপীয় ইউনিয়েনের নেতারা একটি বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন সোমবার। সংস্থাটির নির্বাহী এই ঘটনাকে ‘ছিনতাই’ বলে বর্ণনা করছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এই ঘটনাটিকে একটি ‘ন্যাক্কারজনক ঘটনা’ বলে উল্লেখ করেছে।
গ্রিস থেকে লিথুয়ানিয়াগামী বিমানটিকে বোমা হামলার হুমকির কথা বলে গতিপথ বদলে মিনস্কের বিমানবন্দরে অবতরণ করতে বাধ্য করে বেলারুশ। পরে সাংবাদিক এবং আন্দোলনকর্মী রোমান প্রোতেশেভিচকে গ্রেফতার করে বেলারুশের পুলিশ।
২৬ বছর বয়সী এই সাংবাদিক এথেন্স থেকে আসা রায়ানএয়ারের বিমানটিতে উঠেছিলেন। এটি ভিলনিয়াসের বিমানবন্দরে অবতরণের কিছু আগে বেলারুশের কতৃপক্ষ হস্তক্ষেপ করে এবং মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে বিমানটিকে মিনস্কের বিমানবন্দরে নিয়ে এসে অবতরণ করায়।
বেলারুশের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, বোমা হামলার হুমকি ইস্যুতে ব্যবস্থা নিতে প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো ব্যক্তিগতভাবে নির্দেশ দেন, কিন্তু হুমকিটি পরে ভুয়া প্রমাণিত হয়। শেষে নির্ধারিত সময়ের প্রায় সাত ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে নয়টার দিকে বিমানটি লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে অবতরণ করে।
সেখানে পৌঁছানো যাত্রীরা জানান যে, মাঝপথে মিনস্কে বিমান অবতরণ সম্পর্কে তাদেরকে আগে থেকে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। একজন জানান, সাংবাদিক রোমান প্রোতেশেভিচ ‘প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম এবং এটা ছিল খুবই দুঃখজনক।’
মনিকা সিমকিনি নামে অন্য এক যাত্রী বার্তাসংস্থা এএফপি’কে জানান, ‘তিনি শুধু যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন যে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।’
এরইমধ্যে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটোকে আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব হুঁশিয়ার করে বলেছেন, এ ধরনের ‘অপ্রত্যাশিত আচরণের’ কারণে ‘গুরুতর পরিণতি’ আসতে পারে।
বেলারুশের বিরোধীদলীয় নেতা সেভেতলানা তিখানোভস্কায়া সাংবাদিক প্রোতেশেভিচের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সেভেতলানা গত বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কোর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। অবশ্য ওই নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ আনা হয়েছিল।
১৯৯৪ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতায় থাকা ৬৬ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো গত বছরের আগস্ট মাসের নির্বাচনের পর থেকে ভিন্নমতাবলম্বীদের মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করছেন। অনেক বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিংবা তিখানোভস্কায়ার মতো অনেকে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
বিমানটিকে যেভাবে ঘুরিয়ে নেওয়া হয়
ফ্লাইট এফআর৪৯৭৮ এথেন্স থেকে ভিলনিয়াসে যাচ্ছিল। তবে লিথুয়ানিয়ার সীমান্তের কাছে পৌঁছানোর পরপরই এটি পূর্ব দিকে ঘুরে মিনস্কের দিকে যাত্রা করে। গ্রিস এবং লিথুয়ানিয়া জানায়, সেসময় বিমানটিতে ১৭১ জন যাত্রী ছিলেন।
এক বিবৃতিতে রায়ানএয়ার জানায়, ক্রুদের বেলারুশ জানিয়েছিল যে, বিমানটিতে নিরাপত্তা হুমকি রয়েছে এবং সেটিকে পার্শ্ববর্তী বিমানবন্দর মিনস্কে অবতরণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তবে বিমান চলাচল সংক্রান্ত ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডারটুয়েন্টিফোর-এ দেখা যায় যে, বিমানটিকে যখন ঘুরিয়ে নেওয়া হয় তখন সেটি আসলে মিনস্কের তুলনায় ভিলনিয়াসের বিমানবন্দরের কাছাকাছি ছিল।
রায়ানএয়ার জানায়, মিনস্কে তল্লাশি চালানোর পর সেখানে ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছু পাওয়া যায়নি এবং স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫০ মিনিটে সেটি মিনস্ক ত্যাগ করে। তারা জানায়, ‘এ ঘটনায় ভুক্তভোগী যাত্রীদের সবার কাছে অপ্রত্যাশিত বিলম্বের কারণে ক্ষমা চাইছি। তবে পরিস্থিতি রায়ানএয়ারে নিয়ন্ত্রণে ছিল না।’
রায়ানএয়ারের বিবৃতিতে সাংবাদিক প্রোতেশেভিচের কোনো উল্লেখ করা হয়নি। নেক্সটা-তেই প্রথম তার গ্রেফতারের খবর প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, বিমান এবং এতে থাকা যাত্রীদের তল্লাশি করার পরই প্রোতেশেভিচকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বেলারুশের রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা বেলটা-তে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো ব্যক্তিগতভাবে বোমা থাকার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিমানটিকে ঘুরিয়ে মিনস্কে অবতরণ করানো এবং মিগ-২৯ যুদ্ধ বিমান মোতায়েন করার নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রতিক্রিয়া
এ ঘটনায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এবং সেটা বেড়েই চলেছে। বেলারুশে থাকা মার্কিন রাষ্ট্রদূত জুলি ফিশার এক টুইটে বলেছেন, সাংবাদিককে গ্রেফতারের জন্য প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কো বোমা থাকার মিথ্যা ভয় দেখিয়ে এবং যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে ‘ন্যাক্কারজনক’ কাজ করেছেন।
ইউরোপজুড়ে এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইছে। তারা সাংবাদিক প্রোতেশেভিচের দ্রুত মুক্তি এবং ঘটনার পূর্ণ তদন্তের দাবি জানাচ্ছে। লিথুয়ানিয়ার প্রেসিডেন্ট গিতানাস নসেদা ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে বেলারুশের ওপর নতুন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন।
অবশ্য প্রেসিডেন্ট লুকাশেঙ্কোসহ বেলারুশের অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই ইউরোপে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাসহ নানারকম অবরোধ আরোপ করা আছে।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডের লিয়েন বলেছেন, ‘এই ন্যাক্কারজনক এবং বেআইনী আচরণের.... পরিণতি ভোগ করতে হবে।’ পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ম্যাতেউজ মোরাউইকি এই ঘটনাকে নজিরবিহীন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এটা মারাত্মক এবং বিপজ্জনক একটি ঘটনা।
লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া বলেছে যে, বেলারুশের আকাশসীমাকে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত। লাটভিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এডগার্স রিনবেভিক্স বলেন, এতে সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করা উচিত।
বেসামরিক বিমান চলাচল সম্পর্কিত জাতিসংঘের সংস্থা আইকাও বলেছে, এ ধরনের জোরপূর্বক বিমান অবতরণের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন এবং এটি শিকাগো কনভেনশনের লঙ্ঘন হতে পারে। আকাশসীমা এবং বিমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শিকাগো কনভেনশন হয়েছিল।
প্রোতেশেভিচ কে এবং নেক্সটা কী?
নেক্সটা একটি গণমাধ্যম যার একটি টেলিগ্রাম চ্যানেল রয়েছে। এছাড়া টুইটার এবং ইউটিউবেও গণমাধ্যমটিকে পাওয়া যায়। বেলারুশের নির্বাচনের সময় এটি বিরোধীদলগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং পরবর্তীতেও তা অব্যাহত রাখে। বিশেষ করে সরকার সংবাদ সম্প্রচার প্রায় শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার সময়েও।
বেলারুশের বিরোধীদলীয় নেতা সেভেতলানা তিখানোভস্কায়া বলেন, ২৬ বছর বয়সী প্রোতেশেভিচ ২০১৯ সালে বেলারুশ ছাড়েন এবং নেক্সটার সাথে মিলে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের খবর প্রচার করেন। এরপরে তার বিরুদ্ধে বেলারুশে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।
তিনি বলেন, বেলারুশে তাকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হবে কারণ তাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পশ্চিমা নেতারা তিখানোভস্কায়াকে সমর্থন দিয়েছেন যিনি দেশ ছেড়ে লিথুয়ানিয়ায় যেতে বাধ্য হওয়ার আগে নির্বাচনে জয় পাওয়ার দাবি করেছিলেন। তার স্বামীকে কারাগারে পাঠানোর কারণে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারার পর তিনি নিজেই প্রার্থী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
গত বছর লুকাশেঙ্কো জয় ঘোষণার প্রতিবাদে লাখ লাখ মানুষ রাজধানী মিনস্কে কয়েকমাস ধরে বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। পুলিশি নির্যাতনের অসংখ্য অভিযোগ ছাড়াও শুধু চলতি বছরেই ২৭০০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম