ফ্রান্সের মায়োতে দ্বীপে ঘূর্ণিঝড়ে হাজারো মানুষের মৃত্যুর শঙ্কা
• ফ্রান্সের দরিদ্র-কবলিত মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে ৯০ বছরে ভয়াবহ ঝড়ের তাণ্ডব
• ঘূর্ণিঝড় চিডোর আঘাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির শঙ্কা
• ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান পেতে লাগবে কয়েক দিন
• ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে দ্বীপের বেশিরভাগ এলাকা
আফ্রিকা মহাদেশ লাগোয়া ভারত মহাসাগরীয় ফ্রান্সের দারিদ্র্য কবলিত মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে প্রায় শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে হাজারও মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত শনিবার ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার বাতাসের গতিবেগ নিয়ে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় চিডো। স্মরণকালের ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়া মায়োতের বাসিন্দারা পরমাণু যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির মাঝে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ধ্বংস্তূপে পরিণত হওয়া মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে জীবিতদের সন্ধানে তল্লাশি অভিযান পরিচালনা করছেন জরুরি উদ্ধারকর্মীরা। দ্বীপের সকল পরিষেবা পুনরায় সচল করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা। প্রায় এক শতাব্দীর মধ্যে ভারত মহাসাগরীয় এই দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানা সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে শত শত, এমনকি হাজারও মানুষ মারা গেছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গত শনিবার পূর্ব আফ্রিকাসংলগ্ন ওই দ্বীপপুঞ্জের বিশাল অংশে ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটারেরও বেশি বাতাসের গতিবেগ নিয়ে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় চিডো। এতে পাহাড়ের ধারের শত শত বাড়িঘর মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের ব্যবস্থা পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ফ্রান্সের ভারপ্রাপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রিটেইলেউ দুর্যোগ কবলিত অঞ্চলে পৌঁছে বলেছেন, দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে আমাদের কয়েক দিন লাগবে। রাজধানী মামুদজুর প্রধান হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের নার্স ওশেন ফরাসি সম্প্রচারমাধ্যম বিএফএম টিভিকে বলেন, ‘‘ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী মায়োতের দৃশ্য সর্বগ্রাসী। এটি বিপর্যয়। এখানে কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট নেই।’’
শিক্ষক হামাদা আলী রয়টার্সকে বলেন, রাস্তাঘাট কাদা ও গাছপালায় ঢাকা পড়েছে। লোকজন স্কুলে আশ্রয় নিচ্ছেন এবং রান্নার জন্য বোতলজাত পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি স্টিলের একটি পাতের আঘাতে একজনকে জখম হতে দেখেছি...স্টিলের পাতের তৈরি ছাদযুক্ত বাড়িগুলো ঘূর্ণিঝড়ে উড়ে গেছে। সেখানে অনেক বাড়িঘরের সামান্যতম চিহ্নও আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
দ্বীপের বাসিন্দারা পানি ও অন্যান্য মৌলিক জিনিসপত্রের সন্ধানে মুদি দোকানের বাইরে সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। দ্বীপের বিশাল অংশজুড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। দ্বীপের বাইরে বসবাসরত আত্মীয়স্বজনদের অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মরিয়া হয়ে আপনজনদের বিষয়ে জানতে চাচ্ছেন। একজন বলেন, ‘‘আমি দ্বীপের চিকনি এলাকার সর্বশেষ তথ্য চাই। সেখানে আমার ভাই, শ্যালিকা এবং ভাগ্নী আছে। আমি শনিবার থেকে তাদের কোনও খবর পাচ্ছি না।’’
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ মায়োতে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। দেশটির ভারপ্রাপ্ত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনেভিভ ড্যারিউসেক বলেছেন, ঝড়ের সময় ঢুকে পড়া পানি পরিষ্কার করার পর কার্যক্রম শুরু করেছে মামুদজুর প্রধান হাসপাতাল। সেখানে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য একটি ফিল্ড ক্লিনিক স্থাপন করা হবে। এছাড়া অন্তত ১০০ জন অতিরিক্ত চিকিৎসক মোতায়েন করা হবে।
মায়োতের মোট ৩ লাখ ২১ হাজার মানুষের তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি তুলনামূলক দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করেন। সেখানকার পরিসংখ্যান সংস্থা আইএনএসইইর ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, মায়োতে দ্বীপপুঞ্জের বাসিন্দাদের মাথাপিছু বার্ষিক আয় মাত্র ৩ হাজার ইউরো; যা ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের পার্শ্ববর্তী ইলে-ডি-ফ্রান্স অঞ্চলের তুলনায় প্রায় আট গুণ কম।
• ৯০ বছরে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় চিডো
কমোরোস দ্বীপপুঞ্জের কাছে অবস্থিত মায়োতে দ্বীপপুঞ্জ প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের শাসনের আওতায় আসে ১৮৪১ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ এলাকার মায়োতে মূলত দুটি প্রধান দ্বীপ নিয়ে গঠিত।
গত কয়েক বছর ধরে এই দ্বীপপুঞ্জে ব্যাপক অস্থিরতা চলছে। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি ও নথিবিহীন অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে সেখানে সংকট চলছে। ২০২২ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মেরিন লে পেনের পক্ষে দ্বীপের ৬০ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এর মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলটি অতি-ডানপন্থীদের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
ফরাসি আবহাওয়াবিষয়ক সংস্থা মেটিও ফ্রান্স বলেছে, গত ৯০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে মায়োতে দ্বীপপুঞ্জে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় চিডো। মায়োতের বাসিন্দা ফ্রাঙ্কোস-জেভিয়ার বিউভিল বলেন, আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়ে নিশ্চিতভাবেই শত শত, সম্ভবত কয়েক হাজার মানুষ মারা গেছেন।
সূত্র: রয়টার্স, বিবিসি।
এসএস