কলকাতায় মূর্তি ভাঙচুরকে বাংলাদেশের বলে প্রচার ভারতীয় গণমাধ্যমের
দাবি
বাংলাদেশে মন্দির ভাঙচুর এবং হিন্দু দেবতার মূর্তি ধ্বংস করছে জনতা।
ফ্যাক্ট চেক
ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার একটি মন্দিরের। ৬০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য মেনে গত ২৬ নভেম্বর মূর্তি ভেঙে ফেলেন সেখানকার হিন্দুরা। পূর্ব বর্ধমানের সুলতানপুর পূজা কমিটির একজন সদস্য এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে দেবী কালীর মূর্তি ভেঙে ফেলার জন্য মানব পিরামিড তৈরি করার একটি ঘটনাকে বাংলাদেশের বলে প্রচার করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম আরটি ইন্ডিয়া। রাশিয়ার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যমের ভারতীয় শাখা আরটি ইন্ডিয়ার প্রচার করা সংবাদে মিথ্যা দাবি করে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে বিক্ষুব্ধ জনতা একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়ে কালী মূর্তি ভাঙচুর করেছে।
আরটি ইন্ডিয়ার এই সংবাদের ফ্যাক্ট চেক করেছে ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (আইএফসিএন) অনুমোদিত ভারতীয় প্রতিষ্ঠান বিওওএম (বুম)। ভারতীয় ফ্যাক্ট চেকিং এই সংস্থা বলেছে, আরটি ইন্ডিয়ার প্রচারিত ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার। আর ভিডিওতে ধারণ করা দৃশ্যগুলো সাম্প্রদায়িক ধাঁচের নয়।
পূর্ব বর্ধমানের সুলতানপুর পূজা কমিটির একজন সদস্য বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন, হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে গত ২৬ নভেম্বর সেখানকার একটি মন্দিরে মূর্তিটি ভেঙে ফেলা হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি একটি কালী মূর্তির মাথা ভেঙে ফেলছেন। এ সময় সেখানে উপস্থিত অন্যান্যরা সতর্কতার সঙ্গে মূর্তিটির মাথা ভেঙে ফেলার দিক-নির্দেশনাও দেন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ভিডিওটি শেয়ার করে আরটি ইন্ডিয়া ক্যাপশনে লিখেছে, ‘‘বাংলাদেশে হিন্দু মন্দিরে হামলা—ফুটেজে জনতা মূর্তি ভাঙচুর এবং ধ্বংস করেছে বলে দাবি করা হয়েছে।’’ পরে ব্যবহারকারীরা এই পোস্টের সমালোচনা করায় তা মুছে ফেলে আরটি ইন্ডিয়া।
পোস্টটি দেখতে এখানে ক্লিক করুন...
ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংবাদমাধ্যম সুদর্শন নিউজ একই ভিডিও পোস্ট করে দাবি করেছে, ‘‘বাংলাদেশে চরমপন্থীরা একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা চালিয়ে কালীর মূর্তি ধ্বংস করেছে।’’
সুদর্শন নিউজের পোস্ট দেখতে এখানে ক্লিক করুন...
• ফ্যাক্ট চেক
বুম বাংলায় কি-ওয়ার্ড লিখে এই ভিডিওর বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে। অনুসন্ধানে চলতি বছরের ২১ অক্টোবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দৈনিক স্টেটসম্যানে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন খুঁজে পায় তারা। প্রতিবেদনে একটি ছবি যুক্ত করে দৈনিক স্টেটসম্যান। যে ছবির সাথে ভাইরাল ভিডিওতে দৃশ্যমান দেবী কালীর মূর্তির ছবির মিল রয়েছে।
দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব বর্ধমানের খন্ডঘোষ ব্লকের সুলতানপুর গ্রামের একটি মন্দিরে ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী কালী পূজা হয়। গ্রামের কামার সম্প্রদায় পূজার সূচনা করলেও পরে তারা গ্রামের মণ্ডল পরিবারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। গ্রামের লোকজনকে নিয়ে সেখানে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই গ্রামের সব পরিবার পূজায় অংশ নেয় এবং আচার পালনে সহায়তা করে।
দেশটির এই সংবাদমাধ্যম বলছে, মন্দিরে ১২ ফুট উচ্চতার একটি কালী মূর্তির নিয়মিত পূজা করা হয়। ঐহিত্য অনুযায়ী, এক যুগ পরপর সেই মূর্তিটি বিসর্জন দেওয়া হয়। এ বছরও প্রথা অনুযায়ী, প্রতিমা বিসর্জন হবে। তারপর নতুন করে তৈরি করা মূর্তি দিয়ে আবারও পূজা শুরু হবে। এর ঠিক ১২ বছর পর পরবর্তী বিসর্জন অনুষ্ঠিত হবে।
সুলতানপুরের কালী পূজা সম্পর্কে বাংলায় কীওয়ার্ড অনুসন্ধানে একই ঘটনার একটি ভিডিও সম্বলিত ফেসবুক পোস্ট পাওয়া যায়।
ফেসবুক পোস্টটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে...
• ৬০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য মেনে চলে মণ্ডল পরিবার
সুলতানপুর কালী পূজা কমিটির সদস্য দেবাশীষ মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বুম। হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল ভিডিও পাঠিয়ে তার কাছে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তখন ভিডিওটি সুলতানপুর গ্রামের মন্দিরের কালী মূর্তি বিসর্জনের বলে নিশ্চিত করেন দেবাশীষ মণ্ডল। গত ২৬ নভেম্বর সুলতানপুর গ্রামে কালী মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয় বলে জানান তিনি। শুধু তাই নয়, এই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িক কোনও সংশ্লিষ্টতা নেই বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।
দেবাশীষ মন্ডল বুমকে বলেন, ‘‘আমাদের কালীপূজা কয়েকশ বছরের পুরোনো। আমাদের এখানে প্রতি ১২ বছর পর পর এভাবে প্রতিমা বিসর্জন করা হয়। কালী মূর্তিটি লম্বা হওয়ায় এটিকে বিসর্জনের জন্য মন্দির থেকে বের করা যায় না। যে কারণে আমরা মূর্তিটি ভেঙে ফেলি। তবে মূর্তি ভাঙার আগে আলাদা জায়গায় এর ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করা হয়।’’
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘‘কথ্য রয়েছে, দেবী স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে গ্রামবাসীকে এভাবে প্রতিমা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মূর্তিটি ভাঙার আগে একটি মাটির পাত্রে ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ করা হয়। পরে মন্দিরের পাশের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।’’
এই ঘটনার সাথে কোনও ধরনের সাম্প্রদায়িক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। পূর্ব বর্ধমানের সুলতানপুর কালী পূজা কমিটির সদস্য দেবাশীষ বলেন, ‘‘সুলতানপুর গ্রামের সবাই মিলে এই পূজা করেন। মন্দির ভাঙচুরের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।’’
এসএস