দ. কোরিয়ায় হঠাৎ সামরিক আইন জারি কেন?
দক্ষিণ কোরিয়ায় জরুরি ভিত্তিতে সামরিক আইন জারি করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। মঙ্গলবার গভীর রাতে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ওয়াইটিএনে দেওয়া জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে সামরিক আইন জারির এই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
সামরিক আইন জারির আকস্মিক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল বলেছেন, উদার এবং সাংবিধানিক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সামরিক আইন জারির পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া তার আর কোনও উপায় ছিল না। তিনি বলেন, বিরোধী দলগুলো সংসদীয় প্রক্রিয়া জিম্মি করে দেশকে সংকটের মাঝে ফেলে দিয়েছে।
‘‘আমি উত্তরের কমিউনিস্ট শক্তির হুমকি থেকে মুক্ত কোরিয়ার প্রজাতন্ত্র রক্ষা, জনগণের স্বাধীনতা ও সুখ লুণ্ঠনকারী ঘৃণ্য উত্তর কোরিয়াপন্থী রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলোকে নির্মূল এবং উদার সাংবিধানিক সুরক্ষার জন্য সামরিক আইন ঘোষণা করছি।’’
সামরিক আইন জারি করায় জরুরি সময়ে দেশটির সামরিক কর্তৃপক্ষের শাসন চলবে এবং স্বাভাবিক নাগরিক অধিকার স্থগিত থাকবে। সামরিক আইন জারির পর দক্ষিণ কোরিয়ায় সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন দেশটির সামরিক আইনবিষয়ক কমান্ডার পার্ক আন-সু।
আরও পড়ুন
যদিও দেশটির জাতীয় পরিষদের সদস্যরা গভীর রাতে সংসদে সামরিক আইন জারির বিরুদ্ধে এক ভোটাভুটিতে অংশ নেওয়ার জন্য সংসদ ভবনের ভেতরে জড়ো হচ্ছেন বলে দেশটির গণমাধ্যম খবর দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন দল পিপল পাওয়ার পার্টি ও সংসদের প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি সামরিক আইনের ঘোষণা ঠেকানোর অঙ্গীকার করেছে। উভয় দলই প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির ঘোষণাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে তা ঠেকাতে ভোটের ডাক দিয়েছে।
• হঠাৎ সামরিক আইন জারির নেপথ্যে কী?
দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে ইউন সুক-ইওল ‘‘খোঁড়া হাঁস’’ প্রেসিডেন্টে পরিণত হয়েছেন। সংসদের ওই নির্বাচনে দেশটির বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টি বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়।
জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল যেসব আইন চেয়েছিলেন তা পাস করাতে পারেননি। এর পরিবর্তে বিরোধীদের তোলা যে কোনও বিলে ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে তার দলের।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই প্রেসিডেন্ট নানা ধরনের কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত। বিশেষ করে তার স্ত্রীকে ঘিরে দেশটির সংসদে ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছেন তিনি। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি তার বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও আছে। বিরোধীরা দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশেষ তদন্ত শুরু করার চেষ্টা করছেন। এসব ঘটনা ঘিরে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল গত মাসে দেশবাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন।
চলতি সপ্তাহে ইওলের পিপল পাওয়ার পার্টি এবং প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে আগামী বছরের বাজেট বিল নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা দেয়। দেশটির শীর্ষস্থানীয় কিছু সরকারি প্রসিকিউটরকে অভিশংসন এবং সরকারি বাজেট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিরোধী দল ডেমোক্রেটিক পার্টির একটি প্রস্তাব সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পেয়েছে।
এছাড়া বিরোধীরা মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভিশংসনেরও প্রস্তাব তুলেছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ফার্স্ট লেডির বিরুদ্ধে ওঠা তদন্তে ব্যর্থতার দায়ে দেশটির সরকারি নিরীক্ষা সংস্থার প্রধানকেও অভিশংসিত করতে চেয়েছেন বিরোধীরা।
মূলত বাজেট বিলে বিরোধীদের ভেটো ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের অভিশংসন প্রক্রিয়া নিয়ে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটি ঘিরে সামরিক আইন জারির পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইউন। বাজেট প্রস্তাবে বিরোধীদের সমর্থনের পর তাদের উত্তর কোরিয়াপন্থি হিসেবে আখ্যা দিয়ে নির্মূলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল।
• কে এই ইউন সুক-ইওল?
২০২২ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন পিপল পাওয়ার পার্টির নেতা ইউন সুক-ইওল। পিপল পাওয়ার পার্টির এই নেতা গত নির্বাচনে মাত্র শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ পয়েন্টের ব্যবধানে বিরোধী দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী লি জা-মিউংকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৯৮৭ সালে সরাসরি নির্বাচন শুরু করার পর এটিই ছিল দুই প্রার্থীর অত্যন্ত কম ব্যবধানের নির্বাচনী ফল। বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক আর কেলেঙ্কারির জেরে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে প্রেসিডেন্ট উন সুক-ইওলের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক অবনতি ঘটেছে।
তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। শেয়ার বাজারে জালিয়াতি এবং একটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বিলাসবহুল ডিওর কোম্পানির হ্যান্ডব্যাগ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত মাসে স্ত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ঘটনায় জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন ইউন সুক-ইওল। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, তার স্ত্রীর আরও ভালো আচরণ করা উচিত।
বিরোধীদের নিয়ন্ত্রিত পার্লামেন্টে নিজের এজেন্ডা পাস করাতে ইদানিং চরম বেগ পেতে হচ্ছে ইউনকে।
• সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা
জরুরি ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল সামরিক আইন জারি করার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। মঙ্গলবার দেশটির সামরিক আইনবিষয়ক কমান্ডার পার্ক আন-সু এক বিবৃতিতে এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন।
বিবৃতিতে পার্ক আন-সু বলেছেন, ‘‘দক্ষিণ কোরিয়ায় সমস্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং দেশের সকল গণমাধ্যম সরকারি পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে।’’
তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় সংসদ, স্থানীয় কাউন্সিল, রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট সংস্থার পাশাপাশি সমাবেশ ও বিক্ষোভসহ সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। দেশের সকল গণমাধ্যম এবং প্রকাশনা সামরিক আইন কমান্ডের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।’’
বিবৃতিতে দক্ষিণ কোরিয়ার এই মার্শাল ল কমান্ডার বলেছেন, উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উৎখাত বা অস্বীকার করার চেষ্টা কিংবা ভুয়া খবরের প্রচার, জনমতের বিকৃতি বা মিথ্যা প্রচারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যে কোনও ধরনের শ্রমিক ধর্মঘট এবং রাষ্ট্রীয় কাজের গতিকে মন্থর এমন কর্মকাণ্ড কিংবা সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী সমাবেশ পরবর্তী নির্দেশ জারি না করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ থাকবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে ধর্মঘটে থাকা চিকিৎসকরাসহ স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের অবশ্যই আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কাজে ফিরতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাদের শাস্তির ঝুঁকি নিতে হবে। এই ঘোষণার লঙ্ঘনকারীরা বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার, আটক এবং তল্লাশির শিকার হতে পারেন।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা।
এসএস