ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারের পর ইতালিতে বাংলাদেশিসহ ৪৯ অভিবাসী
ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধারের পর বাংলাদেশিসহ ৪৯ অভিবাসনপ্রত্যাশীকে নিয়ে ইতালির আনকোনায় পৌঁছেছে ইতালিয়ান এনজিও ইমার্জেন্সির উদ্ধারকারী জাহাজ লাইফ সাপোর্ট।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে ছয় জন নারী ও ছয় জন অভিভাবকবিহীন শিশু রয়েছেন। বাংলাদেশি ছাড়াও সেখানে ছিলেন সিরিয়া ও মিসরের নাগরিকেরা।
গত ১৭ নভেম্বর ইতালির আনকোনা বন্দরে পৌঁছায় জাহাজটি। আর অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধার করা হয়েছিল ১২ নভেম্বর। সেদিন সেন্ট্রাল ভূমধ্যসাগরের মাল্টিজ সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ অঞ্চল থেকে তাদের উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা।
সমুদ্রে চলাচলের অনুপযুক্ত একটি নৌকায় করে লিবিয়ার আল-জাওইয়া থেকে তারা রওনা দিয়েছিলেন। ফাইবার গ্লাসের তৈরি নৌকাটির মধ্যে সমুদ্রযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জামের কিছুই ছিল না।
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বেশিরভাগ ছিলেন সিরিয়ার নাগরিক। তবে সেখানে মিসরীয় ও বাংলাদেশিরাও ছিলেন। কোন দেশ থেকে কত জন এসেছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। দাতব্য সংস্থা ইমার্জেন্সি জানিয়েছে, সংঘাত, সহিংসতা, রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই নিজ দেশ ছেড়ে ইউরোপে আশ্রয় নিতে চান এই অভিবাসপ্রত্যাশীরা।
লাইফ সাপোর্ট জাহাজের কালচারাল মেডিয়েটর চিয়ারা পিকিওচি বলেন, “অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই সিরিয়া থেকে এসেছেন। দেশটিতে সংঘাত নিত্যদিনের ঘটনা। বিপন্ন হচ্ছে অসংখ্য মানুষের প্রাণ। কিন্তু এসব বিষয় নিয়ে তারা খবুই কম আলোচনা করতে পারেন।”
লাইফ সাপোর্টের ক্যাপ্টেন ডমেনিকো পুগলিস বলেন, “অবশেষে আমরা উদ্ধার করা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইতালিতে পৌঁছে দিলাম।”
তিনি আরও বলেন, “এই প্রথমবারের মতো কর্তৃপক্ষ আমাদের আনকোনা বন্দরে আসার নির্দেশ দিল। আর পঞ্চমবারের মতো আমাদের উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে পাঠানো হলো। উদ্ধার অঞ্চল থেকে এই বন্দরটির দূরত্ব অনেক।”
চিয়ারা বলেন, “আমরা প্রায়ই এমন গল্প শুনি, কাজের খোঁজে বাধ্য হয়ে কিংবা বৈষম্য থেকে বাঁচতে সিরিয়া ছেড়ে আসেন দেশটির নাগরিকেরা।”
তিনি আরও বলেন, “এটি মনে রাখা দরকার, সশস্ত্র সংঘর্ষের মাত্রা কমে গেলেও যুদ্ধের পরিণতি বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। এই কারণে এখনও অনেক সিরীয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিরিয়া ছেড়ে প্রথমে লিবিয়া এবং তারপরে ইউরোপের দিকে যাচ্ছেন। তারা এমন একটি জায়গা খুঁজছেন যেখানে উন্নত জীবন রয়েছে, যেখানে তাদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখানো হবে। আর আমরা শুধু তাদের মঙ্গল কামনা করতে পারি।”
আরও পড়ুন
৪০ বছর বয়সী এক সিরীয় নারী তার নিজের গল্পটি শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, “সিরিয়া থেকে ফার্মাসিস্টের ডিগ্রি নেওয়ার পর আমি ভেবেছি ইরাকের বাগদাদে চলে যাব। কারণ, নিজ দেশে চাকরি পাচ্ছিলাম না আমি। বিষয়টি এতটা সহজ ছিল না, কিন্তু পরিবার আমার ওপর আস্থা রেখেছিল। আমি ইরাকে বহু বছর থেকেছি এবং কাজ করেছি। এক সময় সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি ইউরোপে যাব। আগস্টে আমি ইরাক ছাড়লাম। ফ্লাইটে করে বেনগাজি আসি। সেখান থেকে গাড়িতে করে ত্রিপোলি। কারণ, ত্রিপোলিতে ছিলেন অন্যান্য সিরীয় নারীরা।”
তিনি আরও বলেন, “গাড়িতে যখন শুধু নারী এবং চালক হিসাবে একজন পুরুষ থাকেন, তখন তা সন্দেহের চোখে দেখা হয় লিবিয়ায়। বেশ কয়েকটি জায়গায় আমাদের থামানো হলো। তারা (লিবিয়ান সেনারা) আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, আমাদের স্বামীরা কোথায় এবং আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের বলা হলো, লিবিয়ান সেনাদের ‘চাহিদা’ পূরণ করা হলে আমাদের ছাড়া হবে। আমরা না বলতে পারিনি।”
ওই নারী আরও বলেন, “আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আমরা চার বার চেষ্টা করেছি সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার। তিন বার সমুদ্রে আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছে। চতুর্থবারে এসে ইমার্জেন্সি আমাদের উদ্ধার করল। আমরা পার হতে পারলাম। আমাদের নৌকার একটি ইঞ্জিন ভেঙে গেছে, অন্যটি ঠিক মতো কাজ করছিল না। আমরা উপায়হীন হয়ে মাঝ সাগরে ভাসতে থাকলাম। আমাদের অনেকেই মরতে প্রস্তুত হয়ে গেছিলেন। যখন আপনাদের লাল জাহাজটি দেখতে পেলাম, আমরা আবার প্রাণ ফিরে পেলাম। এখন আমি স্বপ্ন দেখি, আমার পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে আমি ইংল্যান্ড যেতে পারবো।”
২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান শুরু করে লাইফ সাপোর্টের জাহাজটি। এ পর্যন্ত ২৬টি সমুদ্র অভিযানে দুই হাজার ৩৪২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে লাইফ সাপাোর্ট।ইনফোমাইগ্রেন্টস
টিএম