পশ্চিমবঙ্গে প্রশ্নের মুখে নারী নিরাপত্তা
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পর নাগরিক সমাজ পথে নেমেছে। নারী নিরাপত্তার দাবি জোরদার হয়েছে। তারা রাত দখলের আন্দোলন করেছেন।
কিন্তু নারীর বিরুদ্ধে অপরাধের প্রবণতা কমছে না। পূর্ব বর্ধমানে ছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু তার আরও একটি নমুনা বলে মনে করা হচ্ছে।
পূর্ব বর্ধমানের ধাত্রীগ্রামে মৃত ওই ছাত্রী কাছেই কালনা শহরে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তে যেত। মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরতো। শুক্রবার সন্ধ্যায় পড়া শেষ হওয়ার পর সে মাকে ফোন করে। ফোনে তার ভয়ার্ত কণ্ঠ শোনা যায় বলে মায়ের দাবি।
মৃত ওই ছাত্রীর মা বলেন, “আমাকে ফোন করলে আমি টিউশন থেকে বাড়ি নিয়ে আসি। কালকে ফোন করে বললো, ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না! এরপরই ফোনটা কেটে যায়। আর কল করে ওকে পাওয়া যায়নি।”
পুলিশে খবর গেলে শুরু হয় অনুসন্ধান। রাতে জিউধারা এলাকার রেলগেট থেকে উদ্ধার হয় ছাত্রীর মরদেহ।
শনিবার কালনা হাসপাতাল থেকে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে ছাত্রীর মরদেহ। সেখানেই ময়নাতদন্ত হয়েছে। পুলিশ খতিয়ে দেখছে, কাদের কথা বলতে চেয়েছিল ওই শিক্ষার্থী। কেউ কি তাকে হুমকি দিয়েছিল? কোনো চাপের মুখে পড়তে হয়েছিল তাকে?
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রীটি কালনা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাটফর্মে উঠছে, আবার নেমে যাচ্ছে। এভাবে ইতস্তত ঘুরতে দেখা গিয়েছে তাকে। সেই সময় কি কারো সঙ্গে কথা বলেছিল সে? কারো জন্য অপেক্ষা করছিল? পুরো বিষয়টি ভাবাচ্ছে তদন্তকারীদের।
মৃত ছাত্রীর মা জানিয়েছেন, তার মেয়ে ধাত্রীগ্রাম এলাকায় সেরা ফল করেছিল পরীক্ষায়। তার প্রতি কারো ঈর্ষা থাকতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে তিনি কিছু বলতে পারেননি। কেউ ছাত্রীকে চাপে রেখেছিল কি না, সে ব্যাপারেও তিনি অন্ধকারে। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে, ছাত্রী আত্মহত্যা করেছিল, নাকি তাকে খুন করে লাইনে ফেলে দেওয়া হয়েছে?
মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, “ময়নাতদন্ত যাতে সঠিকভাবে হয়, সেজন্য আমি বর্ধমান মেডিকেলে কথা বলেছি। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। অপরাধী যেই হোক, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশ্নের মুখে নারী সুরক্ষা
আর জি করের ঘটনার পর একের পর এক এমন ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে নারী সুরক্ষা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলিতে এক চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার হয়। এক্ষেত্রে ধর্ষণ করে খুনের অভিযোগ ওঠে। তীব্র উত্তেজনা তৈরি হয় গ্রামে, হামলা চালানো হয় পুলিশ ফাঁড়িতে।
নদিয়ার কৃষ্ণনগরে এক তরুণীর দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার হয় দুর্গাপূজার মণ্ডপের একাংশে। শহরের জমজমাট একটি এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। পুরুলিয়ায় নদীর চর থেকে উদ্ধার হয় এক তরুণীর ক্ষতবিক্ষত মরদেহ। কাছেই ঝাড়খন্ড সীমানা। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে দুষ্কৃতীরা অপরাধ করেছে বলে অনুমান করা হয়।
মুর্শিদাবাদের ডোমকলে শিশুকে চকোলেট দেওয়ার নাম করে ডেকে নিয়ে নিগ্রহ করার অভিযোগ ওঠে। উত্তরবঙ্গের ফালাকাটাতে ছয় বছরের এক নাবালিকাকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ ওঠে। অভিযুক্ত মারা যায় গণপ্রহারে।
শুধু নাবালিকা, শিশু নয়, অন্যান্য নারীরাও এর শিকার হচ্ছেন। পূর্ব বর্ধমানের মেমারিতে এক প্রৌঢ়াকে ধর্ষণের চেষ্টা করে দুই যুবক।
পরিসংখ্যান ও পরিস্থিতি
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে কমছে নারী নিগ্রহের হার। যদিও একটি ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আর একটি ঘটনা সামনে আসছে।
বিভিন্ন ধরনের যৌন অপরাধের যে হিসেব ব্যুরোর কাছে রয়েছে, তার ২০২২ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে এই ধরনের ঘটনা কমছে। এই নিম্নমুখী হার শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্যান্য রাজ্যেও। এই হার নারীদের বিরুদ্ধে সব অপরাধ, হত্যা ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যদিও হ্রাসের হার অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এখানে কম।
এই তথ্য পরিসংখ্যানের সঙ্গে অভিজ্ঞতা মেলে না বলে অনেকের মত। তারা গভীরে গিয়ে কারণ অনুসন্ধান করছেন।
সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক সুহৃতা সাহা বলেন, “মেয়েদের পণ্য হিসেবে দেখানো হয়। সেটা পাল্টানো দরকার। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি মানুষের মানসিকতা বদলের প্রয়োজন। শিক্ষাই একমাত্র সেটা বদলাতে পারে। মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে ভাবা ও তার লিঙ্গ পরিচয় দিয়ে না ভাবা প্রয়োজন।”
নারী সুরক্ষা কতটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, কতটা সামাজিক ব্যাধি, তা নিয়ে বিতর্ক আছে।
সমাজকর্মী অধ্যাপক শাশ্বতী ঘোষ বলেন, “এটাকে অনেকেই সামাজিক ব্যাধি বলছেন। কিন্তু একথা বলে দায়িত্ব শুধু সামাজিক সংগঠনগুলোর ওপর ঠেলে দিলে হবে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোরও দায়িত্ব আছে। তাদেরও দেখতে হবে, যাতে এ ধরনের সামাজিক অপরাধ প্রশ্রয় না পায়।”
পুলিশের ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “পুলিশের একটা ওয়ার্ক কালচার তৈরি হয়ে গেছে। শাসক দলের লোকেরা বললে তবে পুলিশ ছুটতে শুরু করবে, কিন্তু তার আগে তারা কিছু করবে না। এমনটা চললে অপরাধীরা প্রশ্রয় পাবে। অপরাধ কমানো যাবে না। অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।”
টিএম