ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনে শেখ হাসিনা আর বাংলাদেশ কেন ইস্যু হয়ে উঠেছে?
ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে আগামী সপ্তাহ থেকে দুই দফায় বিধানসভা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তার আগে সেখানকার নির্বাচনি প্রচারে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়া ও বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ গুরুতর ইস্যু হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি মাসখানেক আগে থেকে অভিযোগ তুলে আসছে যে, বাংলাদেশ থেকে ওই রাজ্যে ব্যাপক সংখ্যায় অনুপ্রবেশকারী ঢুকে জায়গা-জমি দখল করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে বারবার বিষয়টির উল্লেখ করে ক্ষমতাসীন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের জোট সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।
এবারে তাদের পাল্টা প্রশ্ন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন যে, বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী করে ভারতে এসে রয়েছেন! বাংলাদেশের সঙ্গে তাহলে কি বিজেপির কোনও সমঝোতা রয়েছে – প্রশ্ন তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
শেখ হাসিনার ভারতে ‘আশ্রয়’ নিয়ে কী বলেছেন হেমন্ত সোরেন?
গত রবিবার ঝাড়খণ্ডে বিজেপির নির্বাচনি ইস্তেহার প্রকাশ করার সময়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ গত মাসখানেকের মধ্যে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ থেকে ঝাড়খণ্ডে অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়টি তুলে ধরেন।
এরই জবাবে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন এক নির্বাচনি জনসভায় বলেন, “এরা সব অদ্ভুত কথাবার্তা বলেন। আপনারা হিন্দু-মুসলমান, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলেন।
“... আমি জানতে চাই বাংলাদেশের সঙ্গে এদের কোনও গোপন সমঝোতা হয়েছে না কি? বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিমান আপনারা এখানে কেন নামতে দিলেন? কী হিসাবে আপনারা তাকে এখানে আশ্রয় দিয়ে রেখেছেন, তার জবাব আমায় দিন,” প্রশ্ন করেন মুখ্যমন্ত্রী।
শুধু শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত হন নি মি. সোরেন।
তিনি ঝাড়খণ্ডে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রফতানি করা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
তার কথায়, “এখানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সেটা আপনারা বাংলাদেশে রফতানি করেন আর আপনারাই আবার বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের কথা বলেন? বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব কার? সেটা তো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে! এখানে রাজ্য সরকার কী করবে?”
বিজেপি বার বার অনুপ্রবেশের কথা তুলছে
নির্বাচনি প্রচারে সোমবার প্রথমবার ঝাড়খণ্ডে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি ক্ষমতাসীন জোটের দিকে সরাসরি আঙ্গুল তুলে বলেন রাজ্যে যে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে, তার জন্য জোটের তিনটি দলই দায়ী।
“ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা, কংগ্রেস আর আরজেডি তুষ্টিকরণের রাজনীতিকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এই তিনটি দল আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এখানকার সামাজিক কাঠামো যাতে ভেঙ্গে পড়ে। এই তিনটি দলই অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থক। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোট পাওয়ার আশায় তারা এদের ঝাড়খণ্ডের সব জায়গায় প্রতিষ্ঠাপন করছে,” এক নির্বাচনি জনসভায় বলেছেন মি. মোদি।
এর আগেও বিজেপির নেতারা বারে বারে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ইস্যুটি তুলে ধরেছেন। তারা অভিযোগ করেন যে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা আদিবাসী জমি যেমন দখল করছে, তেমনই আদিবাসী নারীদের অসম্মানও করছে, এই অভিযোগও করা হয়।
সত্যিই কি ব্যাপক বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ হয়েছে?
ঝাড়খণ্ড নির্বাচনে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ যে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে।
ওই নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে সেখানে বিবিসির যেসব সহযোগী সংবাদদাতারা গিয়েছিলেন, তারাও বলছেন যে রাজধানী রাঁচির মতো বড় শহরে বিষয়টি নিয়ে খুবই আলোচনা হচ্ছে। জাতীয় সংবাদমাধ্যমও অনুপ্রবেশের বিষয় নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে।
জাতীয় তপশীলি জাতি ও উপজাতি কমিশন ঝাড়খণ্ডে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেখানে তারা যেসব এলাকায় নির্দিষ্টভাবে অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে পেরেছে বলে জানানো হয়েছিল, সেরকম কয়েকটি এলাকায় গিয়েছিলেন বিবিসির সহযোগী সংবাদদাতারা।
তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে যে কথা শুনে এসেছেন, যে চিত্র সরেজমিনে দেখেছেন, তাতে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে আদিবাসী এলাকাগুলিতে অনুপ্রবেশকারীরা বসবাস করছেন, এমন প্রমাণ তারা পান নি।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের পাকুড় বা সাঁওতাল পরগণা এলাকায় যে বিগত দুই-তিন দশকে অনেক বাংলাভাষী মুসলমান বসতি গড়েছেন, এটাও ঘটনা।
এরা আসলে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার নাগরিক এবং বাংলাভাষী মুসলমান। গঙ্গার নদী ভাঙ্গনের ফলে মালদার দিকে এদের গ্রাম নদীতে তলিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই নদীর একদিকে ভাঙ্গন হলে বিপরীত দিকে চর গজিয়ে ওঠে। মালদার বিপরীতেই ঝাড়খণ্ডের পাকুড় ইত্যাদি অঞ্চল।
কলকাতার সিনিয়র সাংবাদিক ও বিশ্লেষক অমল সরকার বলছেন, “২০০৮-৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ভূমি ও ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা ঝাড়খণ্ডে গিয়ে পাকুড় জেলার ওইসব এলাকা ঘুরে দেখেছিলেন। সেখানে যে মালদা জেলার মানুষ বসবাস করছেন, সেটাও দেখে এসেছিলেন। ঝাড়খণ্ড সরকারের কাছে তিনি আবেদন জানিয়েছিলেন যে ওইসব অঞ্চলগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হোক। সে রাজ্যের সরকার রাজি হয় নি, আর বিষয়টি নিয়ে আর এগোনও হয় নি।“
বিজেপির তৈরি করা ইস্যু?
অমল সরকার বলছিলেন ঝাড়খণ্ডে যেভাবে এবার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকে বড় ইস্যু করে তুলেছে বিজেপি, সেটা তাদের আদিবাসী ভোট নিজেদের দিকে টানার একটা কৌশল।
তার কথায়, “হিন্দুরা যেমন সব পুজোর আগে গণেশ পুজো করে ধর্মীয় আচার পালন শুরু করে, বিজেপির নির্বাচনি প্রচারের আগেও ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়টি তোলা হয়।
“এখানে প্রশ্ন হচ্ছে সেখানে কেন এই ইস্যুটা তারা তুলল? কারণটা স্পষ্ট। আদিবাসী অঞ্চলগুলোতে তারা বিগত কয়েকটি নির্বাচনে অত্যন্ত খারাপ ফল করেছে। গত লোকসভা নির্বাচনে আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত একটা আসনেও তারা জিততে পারে নি। এবার তারা চেষ্টা করছে যাতে আদিবাসী ভোট কিছুটা নিজেদের দিকে টানা যায়। আদিবাসীদের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে -এরকম একটা প্রচার চালালে যদি তাদের মধ্যে কিছু মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয়, সেই চেষ্টা তারা করছে,” বলছিলেন মি. সরকার।
বিবিসির যেসব সহযোগী সংবাদদাতা ঝাড়খণ্ডে গিয়েছিলেন, তাদের বিশ্লেষণও একই।
অমল সরকার বিশ্লেষণ করছিলেন যে ঝাড়খণ্ড রাজ্য তৈরি হওয়ার পর থেকে ১৩ বছর বিজেপিই সরকারে ছিল। সেখানে নিশ্চই আদিবাসীদেরও সমর্থন ছিল তাদের প্রতি। কিন্তু এর আগে বিজেপির যিনি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, সেই রঘুবর দাশের আমলে বিজেপি সরকার এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যার ফলে আদিবাসী সমাজ তাদের থেকে দূরে সরে যায়।
“ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের জমি জায়গা নিয়ন্ত্রিত হয় ছোটনাগপুর টেন্যান্সি অ্যাক্ট এবং সাঁওতাল পরগণা টেন্যান্সি অ্যাক্টের মাধ্যমে। এই আইন দুটি অনুযায়ী আদিবাসীদের জমি জায়গা হাত বদল করা একরকম অসাধ্য। রঘুবর দাশের মন্ত্রীসভা রাজ্যে শিল্পায়নের স্বার্থ দেখিয়ে সেই দুটি আইন শিথিল করার প্রস্তাব এনেছিল। ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল এর বিরুদ্ধে।
“আমার মনে আছে বর্তমান রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মূ তখন ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল ছিলেন। তিনি ওই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তারপরে মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে জানিয়েছিলেন তারা যদি ওই আইন-দুটি শিথিল করার পথ থেকে সরে না আসেন তাহলে আইনশৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি হতে পারে।''
''আদিবাসীদের অধিকারে হাত দেওয়া ঠিক হবে না সরকারের। এরপরে সরকার আইন বদলের প্রস্তাব থেকে সরে আসে, কিন্তু আদিবাসীরাও বিজেপির কাছ থেকে দূরে সরে যায়। এর ফল আমরা পরবর্তী নির্বাচনগুলাতে দেখতেই পাচ্ছি,” বলছিলেন বিশ্লেষক অমল সরকার।
দূরে সরে যাওয়া আদিবাসী ভোটই এখন আবার কিছুটা ফিরিয়ে আনা যায় কী না, সেই প্রচেষ্টারই অঙ্গ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে একটা তৈরি করা ইস্যু সামনে নিয়ে আসা, এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
এসএমডব্লিউ